খিলাফত আন্দোলনের কর্মসূচি সম্পর্কে আলোচনা কর। এবং এ আন্দোলনের ব্যর্থতা আলোচনা কর।

অথবা, খিলাফত আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ কর এবং এ আন্দোলনের ব্যর্থতা বর্ণনা কর।

অথবা, খিলাফত আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ কর এবং এ আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

অথবা, খিলাফত আন্দোলনের বিবরণ দাও। ইহা ব্যর্থ হয়েছিল কেন?

উত্তর: ভূমিকা: ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তুরস্কের খিলাফতকে রক্ষা করার জন্য ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় মুসলমানদের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে তুরস্কের খিলাফতকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও যুদ্ধ শেষে তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে তুরস্ককে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলে। ফলে ভারতীয় মুসলমানরা মওলানা মুহাম্মদ আলী, মওলানা আবদুল বারী ও মওলানা শওকত আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের পিছনে এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলে। পরবর্তীতে গান্ধীজী এই আন্দোলনের গতিবেগ আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এ আন্দোলন বিভিন্ন কারণেই পরবর্তীতে ব্যর্থতার দিকে ধাবিত হয়। এ আন্দোলন ১৯২০ সালে শুরু হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে একদম স্থগিত হয়ে যায়।

খিলাফত আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ: মুসলমানরা খিলাফত আন্দোলনের ঘোষণা দিলে গান্ধীজী এর সাথে একাত্মতা পোষণ করে। খিলাফত অসহযোগ আন্দোলন একীভূত হওয়ার ফলে ভারতীয় ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ প্রসঙ্গে গান্ধীজী বলেন মুসলমানরা একটি অত্যন্ত তাদের পছন্দ না হলে তারা সরকারের সাথে সকল সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব করেছে। ঈশ্বর না করুন শাস্তির শর্তসমূহ শুরুর ঘোষণা দেন। এদিকে বোম্বের মুসলিম প্রতিনিধিগণ বন্ধ করে দেবেন। গান্ধীজি সেই সাথে অসহযোগ আন্দোলন মজলিসে খিলাফত নামে একটি সংস্থা গঠন করেন এবং লক্ষ্ণৌতে সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটির একটি অধিবেশন আহ্বান ও পর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। এই সম্মলনে এ. কে. এম. ফজলুল কা হকের সভাপতিত্বে কতকগুলো প্রস্তাব গৃহীত হয়। যথা-

(ক) সরকার খিলাফতের দাবি না মানলে ব্রিটিশ সরকারের সাথে অসহযোগের ডাক দেয়া হবে।

(খ) ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করতে হবে।

(গ) মুসলমানদের প্রতি অনুরোধ জানানো হবে যে তারা যেন ব্রিটিশ সরকারের বিজয় উৎসবে যোগদান না করে।

১৯২০ সালে মওলানা মোহাম্মদ আলী ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসলে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। মওলানা মোহাম্মদ আলী গান্ধীজীকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন এলাকা সফর করেন এবং ছাত্রদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে আন্দোলন করার জন্য আহ্বান জানান। এছাড়াও ব্যবসায়ীদের দোকান পাট বন্ধ রাখতে বলেন, আইনজীবীদেরকে আদালত ত্যাগ করতে বলেন, ফলে অনেক আইনজীবী পেশা ত্যাগ করে আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২১ সালে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। কলকাতার প্রায় ৩,০০০ ছাত্র রাস্তায় নেমে এসে ধর্মঘট পালন করেন, জাতীয় কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সুভাষ চন্দ্র বসুকে এ কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ দেন। এর আগে সুভাষ চন্দ্র ভারতীয় সিভিল সার্ভিস থেকে ইস্তফা দিয়ে এ কলেজে যোগ দেন।

খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতা: মুসলমানদের খিলাফত রক্ষা করার উদ্দেশ্য ১৯২০ সালে খিলাফত আন্দোলন শুরু হলে পরবর্তীতে এর সাথে ব্রিটিশ বিরোধী আরো অনেক বিষয় যুক্ত হয়। কিন্তু, ১৯২১ সালে এই আন্দোলন বেশ বেগবান হলেও কিছুদিনের মধ্যে এ আন্দোলন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে ব্যর্থতায় পরিণত হয়। নিম্নে ব্যর্থতায় কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

১. ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি: ইংরেজ সরকার খিলাফত আন্দোলনের ভীত হয়ে এ আন্দোলনের নেতাদের বন্দি করতে থাকেন। এ আন্দোলনের অন্যতম নেতৃবৃন্দ মওলানা মুহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী ড. সাইফুদ্দীন কিচল, মওলানা নিসার আলী, পীর গুলাম মুজাদ্দিদ, জগৎগুরু শংকরাচার্য ও মৌলভী হোসাইন আহমদকে বন্দি করা হয়। যার ফলে নেতাশূন্য খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থতায় পরিণত হয়।

২. হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘর্ষ: এ আন্দোলনের প্রথমদিকে হিন্দু- মুসলমান সুসম্পর্ক বজায় থাকলে ১৯২১ ও ১৯২২ ফলে মহররম উপলক্ষে হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব হয়। এছাড়াও ১৯২২ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবে ১৯২৩ সালে মুলতান, অমৃতসর, মিরাট, সিদ্ধ, পাঞ্জাব, এলাহাবাদ, আজমীর মোরাবাদ প্রভৃতি স্থানে হিন্দু- মুসলমান দাঙ্গা ব্যাপক আকার ধারণ করে, ফলে খিলাফত আন্দোলনের গুরুত্ব হারিয়ে যায় এবং ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

৩. যোগ্য সংগঠকের অভাব: খিলাফত আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু এই আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখার মত যথেষ্ট যোগ্য সংগঠকের অভাব ছিল। ফলে বলিষ্ঠ নেতা না থাকায় এ আন্দোলন বেশিদিন গড়াতে পারেনি।

৪. তুর্কি নেতার ঘোষণা : তুরস্কের খিলাফত নিয়ে যখন ভারতীয় মুসলমানরা এত বড় আন্দোলন শুরু করে তখন তুরস্কের নেতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের খিলাফত ভেঙে দিয়ে তুরস্ককে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা হয়। ফলে মুসলমানরা হতাশ হয়ে এ আন্দোলন থেকে সরে আসে ধীরে ধীরে।

৫. মালবারের হত্যাকাণ্ড: মালবারের হত্যাকাণ্ড খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। খিলাফত আন্দোলনের কয়েকজন উগ্রপন্থি মুসলমান বিদ্রোহী হয়ে কয়েকজন ইউরোপীয় ও বহু হিন্দুকে হত্যা করেন। ফলে এই ঘটনা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লে একটি অরাজকপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টি হয়। গান্ধীজী এ হত্যাকাণ্ড উপলক্ষে আন্দোলন সাময়িক ভাবে বন্ধ ঘোষণা দেন। আর এই ঘোষণাই ছিল আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

৬. চৌরিচৌরায় হত্যাকাণ্ড: ভারতের উত্তর প্রদেশের গৌরক্ষপুর জেলার চৌরাচৌরায় নামক স্থানে ১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উন্মত্ত কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক ও চাষিদের হাতে একজন পুলিশ ও চৌকিদার জীবন্ত দগ্ধ হয়। এ আন্দোলন দমন করতে গিয়ে পুলিশ জনতার কাছে আটকে পড়ে এবং তাদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। ফলে গান্ধীজি ও তাঁর কংগ্রেস কর্মীরা এ হত্যাকাণ্ড জড়িত বলে তিনি আন্দোলন সাময়িক ভাবে আন্দোলন স্থগিত করেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে এ আন্দোলন আর বেগবান করা সম্ভব হয়নি।

উপসংহার: আলোচনার শেষ প্রান্তে একথা বলা যায় যে, তুরস্কের খিলাফতকে কেন্দ্র করেই খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়। ১৯২০ সালে এ আন্দোলন বেশ বেগবান হয়েছিল কিন্তু নানা কারণেই ধীরে ধীরে এ আন্দোলনের গতি কমে যায় এবং এ আন্দোলনে যোগ্য নেতৃত্বের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয় যার ফলে এ আন্দোলন ধীরে ধীরে ব্যর্থতার দিকে এগিয়ে যায়। তথাপি ব্যর্থ হলেও আন্দোলন মুসলমান তথা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং অনেক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীজ বপন করেছিল।