অথবা, অসহযোগ আন্দালনের সংজ্ঞা দাও। অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর। এবং এ আন্দোলনের কর্মসূচি আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: ১৯৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে ইংরেজরা বাংলার নবাবকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে তথা বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখলের পর ব্রিটিশরা বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানদের উপর নির্যাতন করে। ফলে ভারতবাসী বিভিন্ন দাবিতে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম ও সংগঠন করেন। ১৮৮৫ সালে নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতবাসীর শক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তখন আন্দোলন সংগ্রামের বিশেষ কোনো গুরুত্ব ব্রিটিশ সরকারের নিকট ছিল না। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে লিপ্ত হলে হিন্দুরা একটি আন্দোলনের সুযোগ পায়। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার নিপীড়নমূলক রাওলাট একটি পাস করলে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এক তীব্র আন্দোলনের ডাক দেন। মহাত্মা গান্ধীও খিলাফত আন্দোলনের কর্মসূচি সালে একাত্মতা ঘোষণা করে পুরো ভারত জুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল স্বরাজ লাভ।
অসহযোগ আন্দোলন : ভারতের মুসলমানরা তুরস্কের খিলাফত রক্ষা করার জন্য যখন খিলাফত আন্দোলনের শুরু করে তখন ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালে নিপীড়নমূলক ভারত শাসন আইন পাস করলে এর প্রতিবাদে জাতীয় কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ভারত শাসন আইনের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের ১৩ মার্চ ধর্মঘটের ডাক দেন। এছাড়া ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরে জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডে শত শত ভারতবাসী নিহত হয়। ফলে ভারতবাসী চুপ করে থাকতে পারেনি। সরকারের বিরুদ্ধে তারা দেশজুড়ে এক আন্দোলনের ডাক দেন, যা ইতিহাসে অসহযোগ আন্দোলন নামে পরিচিত।
অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি: পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো আন্দোলনই একদিনে সংঘটিত হয়নি। এই আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার পিছনে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ঘৃণা প্রভৃতির বাহিঃপ্রকাশ ঘটে।
নিম্নে আন্দোলনের পটভূমি আলোচান করা হলো:
১. রাওলাট এ্যাক্ট পাস: ১৯১৯ সালে ভারতবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসন আইন পাস করে। এই আইন ছিল ভারতবাসীর জন্য নিপীড়নমূলক এবং এ আইনে ভারতবাসীর কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। এই আইনের প্রতিবাদে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেন। এ আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার রাওলাট এ্যাক্ট পাস করার সময় বলা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে এ আইন বাতিল করা হবে। কিন্তু তা করা হয়নি। বরং এ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে বলা হয় যে-
(ক) সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের জেলে দেয়া যাবে।
(খ) এ আইনের দ্বারা জরুরি অবস্থায় যে-কোনো মামলার বিচারক ছাড়াই নিষ্পত্তি করা যাবে।
এই আইনের প্রতিবাদে জানুয়ারি মাসে দেশব্যাপী এক তীব্র প্রতিবাদের ঝড় উঠে। গান্ধীজী এই আইনের প্রতিবাদে একটি শপথ নামায় স্বাক্ষর করেন। সেখানে বলা হয়েছিল ভারতীয় অপরাধ সম্পর্কীয় আইন সংস্কার প্রস্তাব নং ১- ১৯১৯ এবং অপরাধ সম্পর্কীয় আইন জরুরি প্রস্তাব নং ২- ১৯১৯ অন্যায় স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের আদর্শের জন্য ক্ষতিকারক এবং জনগণের প্রাথমিক অধিকারসমূহের প্রতি হুমকিস্বরূপ যে অধিকারের উপর সমগ্র ভারত ও খোদ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নির্ভরশীল এই শপথ নামটিতে আরো বলা হয়, এই প্রস্তাবগুলো আইনে পরিণত হলে এবং বাতিল না করা হলে আমরা এ ধরনের বা অন্য কোনো আইন মানতে অস্বীকার করব। আর ও বলা যায়, জনজীবন ব্যক্তি বা সম্পত্তি বিনাশ ধ্বংস থেকে দূরে থাকতে হবে। গান্ধীজী এই আইনের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের ৩০ মার্চ সারাদেশ ব্যাপী হরতাল ডাকে। এই হরতালে অনেক লোক হতাহত হয়।
২. জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড: রাওলাট এ্যাক্টের প্রতিবাদে ব্রিটিশ সরকারের সৈন্যদের গুলিতে শত শত লোক নিহত হয়। সরকারি হিসাবমতে এই মৃতের সংখ্যা ছিল ৬০৯ জন এবং আহত হয় ২০০ জন। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল প্রায় ১০ হাজার লোক অমৃতসরের জালিয়ানবাগের এক সভায় মিলিত হয়। ১৯১৯ সালের ১২ এপ্রিল ডালদ্ধয় ব্রিগ্রেটের ব্রিটেনের কমান্ডার ডায়ার সমস্ত সভা সমিতি ও মিছিল শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেন। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। আর গান্ধীজী দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি : মওলানা মুহাম্মদ আলী ১৯২০ সালের প্রথমদিকে ভারতে ফিরে আসেন এবং ১৯২০ সালে ২৮ মে বোম্বেতে খিলাফত কমিটির এক সভায় অসহযোগ আন্দোলনের জন্য কর্মসূচি নির্ধারণ করেন এবং ১৯২০ সালের জুন মাসের প্রথমদিকে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে একটি কমিটি গঠন কার। হয় এবং এ কমিটিতে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়।
এ কর্মসূচিগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. স্কুল, কলেজ, আদালত সরকারি পরিষদ ও সরকারি চাকরি বর্জন ইত্যাদি।
২. খেতাব ও পদবি বর্জন।
৩. বিদেশি পণ্য বর্জন ও স্বদেশি পণ্য ব্যবহার।
৪. চরকায় সুতা কাটার উৎসাহ দান।
৫. ব্রিটিশ আদালতের পরিবর্তে পঞ্চায়েত গড়ে তোলা।
৬. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা এবং অস্পৃশ্রতা দূরীকরণ ইত্যাদি।
অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করাই খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন ক্রমে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। গান্ধীজির ডাকে ছাত্র-ছাত্রীগণ স্কুল কলেজ ছেড়ে রাজপথে নামে। আইনজীবীগণ আদালত ত্যাগ করেন, বিদেশি পণ্যসামগ্রী বর্জন ও পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং সব জায়গার দেশীয় পণ্য ব্যবহারের উৎসাহিত করা হয়। ১৯২১ সালে প্রিন্স অব ওয়েলস বোম্বাই ও কলকাতার উভয় শহরে ধর্মঘট পালিত হয় এবং খিলাফত আন্দোলন ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ভারতবাসীকে পরবর্তীতে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি গঠনে সহযোগিতা করেছিল। এ আন্দোলন ছিল ভারতবাসীর একমাত্র উদ্দীপনা ও আত্মোৎসর্গ। গান্ধীজী এ আন্দোলনকে আত্মশক্তি ও বৈষয়িক শক্তির মধ্যে এ আন্দোলন বলে অভিহিত করেনে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, অসহযোগ আন্দোলন ছিল ভারতীয় জনসাধারণের জন্য একটি সচেতনতাবোধ জাগ্রত করার আন্দোলন। ঐ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে ভারতবাসী অনেকটা জাতীয় চেতনাসম্পন্ন হয়ে উঠে।