রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা কর।

অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির মধ্যকার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যসমূহ বর্ণনা কর।

অথবা, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যকার সম্পর্ক ও পার্থক্য আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের জ্ঞান একান্ত আবশ্যক। সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম শাখা হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান। তাই সামাজিক বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি, বিশ্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান একান্ত আবশ্যক। গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল বলেন, “মানুষ মাত্রেই রাষ্ট্রীয় জীব। যারা রাষ্ট্রীয় আওতার বাইরে তাদের স্থান মানবসমাজের উপরে বা নিচে।” মনীষী বেকনও অনুরূপ উক্তি করেছেন, “নির্জনতা যারা কামনা করে তারা হয় দেবতা না হয় পশু।” সুতরাং রাষ্ট্র ব্যতীত কারও পক্ষেই সুষ্ঠু জীবনযাপন সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির মধ্যকার সম্পর্ক: রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির মধ্যে তয়েছে সুগভীর সম্পর্ক। উভয়ের মাঝে সম্পর্কিত কতিপয় দিক নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১. একই পরিবারভুক্ত: সামাজিক বিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা হল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অর্থনীতি ছাড়া সমাজবিজ্ঞানের তথ্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিপূর্ণতা অসম্ভব। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান উভয় শাস্ত্রই সমাজবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে থাকে।

২. পরস্পর পরিপুরক: সমাজের সমস্যা নির্ণয় ও সমাধান এবং উন্নতি অগ্রগতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি একে অপরের পরিপূরক। রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেমন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে পর্যালোচনা করে, তেমনি অর্থনীতি রাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করে। উভয় শাস্ত্রের উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্র ও নাগরিকের কল্যাণ সাধন করা।

৩. পারস্পরিক সম্পর্ক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্যবিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র, সরকার এবং জনগণ। এগুলোর প্রত্যেকটির সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া রাষ্ট্র, সরকার এবং জনগণ কোনটিরই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।।

৪. তত্ত্বগত সম্পর্ক: অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মধ্যে অনেক তাত্ত্বিক সম্পর্ক বা মিল বিদ্যমান রয়েছে। অর্থনৈতিক মতবাদের উপর ভিত্তি করে যেমন অনেক রাজনৈতিক মতবাদ গড়ে উঠেছে, তেমনি রাজনৈতিক মতবাদের উপর ভিত্তি করে অনেক অর্থনৈতিক মতবাদ গড়ে উঠেছে। তাছাড়া একই তাত্ত্বিক অনেক সময় রাজনৈতিক মতবাদ ও অর্থনৈতিক মতবাদের উপর পারস্পরিক ক্রিয়াগত তত্ত্ব প্রদান করেছেন।

৫. উভয়ের উদ্দেশ্য অভিন্ন : রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্রের সার্বিক কার্যাবলি নিয়ে পর্যালোচনা করে এবং দেশ ও জাতির ক্রমোন্নতির জন্য চেষ্টা করে। অর্থনীতি দেশ ও জনকল্যাণে অর্থনৈতিক দৈন্যতা বিদূরিত করে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, উভয়ের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অভিন্ন।

৬. রাষ্ট্রবিজ্ঞান অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রথমে জনগণের সচেতনতা, কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্ঠা, সততা নিশ্চিত করতে হবে। বাণিজ্য চুক্তি, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, ভূমি ও কর ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি রাষ্ট্র ও সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মূলত রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণের সহায়তা ছাড়া কোনও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই বলা যায়, “Political stability is the pre-condition of economic development.” এজন্য বলা হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি।

৭. পারস্পরিক প্রভাব: অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাব বিভিন্নভাবে পড়ে। রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়লে অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যায়। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রনীতির উপরও অর্থনীতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিপ্লব ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়ে থাকে।

৮. উভয়ের সহাবস্থান: কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি পাশাপাশি অবস্থান করে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাঠামো যেমন- করনীতি, শিপনীতি, বাণিজ্যনীতি ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় আইনের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়। একের প্রতি অন্যের উদারনীতি ও সহযোগিতা বাঞ্ছিত কল্যাণ লাভে সহায়তা করে।

৯. শুরুতে একই শাস্ত্র ছিল: জ্ঞান চর্চার শুরু থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি একই শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন এ দু’শাস্ত্রের কোন ভিন্ন নাম বা কার্যক্রম ছিল না। এ দু’শাস্ত্রের সমন্বিত নাম হলো রাজনৈতিক – অর্থব্যবস্থা (Political economy)। পরবর্তী কালে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশের ফলে এ দু’শাস্ত্রকে পৃথক করা হয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির মধ্যে পার্থক্য/বৈসাদৃশ্য: উভয়ের সংজ্ঞা, বিষয়বস্তু, কার্যপদ্ধতি, অবকাঠামো পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, গতিপ্রকৃতি, পরিধি বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত পার্থক্যগুলো লক্ষ্য করা যায়:

১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য: অর্থনীতি হলো এমন একটি বিদ্যা যে বিদ্যা সর্বদা মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটানোর কাজে ব্যস্ত। অন্যদিকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানুষের রাজনৈতিক আচরণ বিশ্লেষণ অর্থাৎ অর্থনীতি অর্থ সম্পর্কিত বিষয়াদি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়াদি আলোচনা করে।

২. পরিধি: পরিধিগত দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিধি একক অর্থে অর্থনীতি অপেক্ষা ব্যাপকতর। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় বিষয়াদি এমনকি দেশের জাতীয় বাজেটের বিষয়টিও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি কর্তৃক নির্ধারিত। সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞান অর্থনীতির উপরও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। কিন্তু অর্থনীতি যেহেতু মানুষের অর্থনৈতিক বিষয়াদি, অর্থাৎ মানুষের চাহিদা, সম্পত্তি ও সম্পদ সম্পর্কিত বিষয়াদি বিশ্লেষণ করে তাই এর পরিধি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তুলনায় সংকীর্ণ।

৩. গতিপ্রকৃতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজবাসীর রাজনৈতিক জীবনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোকপাত করে। কিন্তু অর্থনীতির আলোচনা হলো সমাজবদ্ধ মানুষের অর্থনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টার বিচার বিশ্লেষণ।

৪. কার্যাবলি: মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলির আলোচনা হলো অর্থবিদ্যা। সীমাবদ্ধ উপায় উপকরণের দ্বারা সীমাহীন অভাব মেটানোর প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করেই মানুষের যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যকলাপের সূত্রপাত ঘটে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান হলো একটি নীতিনিষ্ঠ বিজ্ঞান। এ যুগের কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলোচনাকে জ্ঞাননিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ বলে দাবি করলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নীতিনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলে স্বীকৃতি পায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রবিজ্ঞান মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের উপর গুরুত্বারোপ করে।

৫. ভবিষ্যদ্বাণী: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণী করার কোন ক্ষমতা নেই। কারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সংখ্যাতত্ত্বের বিষয়টি খাটে না। কিন্তু অর্থনীতি পারে। কারণ অর্থনীতির সিদ্ধান্তসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংখ্যাতত্ত্বের বৈজ্ঞানিক ভাষায় প্রকাশিত হয়। তাই সঠিক বিজ্ঞান হিসেবে ধনবিজ্ঞানের দাবি রাষ্ট্রবিজ্ঞান অপেক্ষা জোরালো।

৬. বিষয়বস্তু: অর্থনীতিবিদ Ivor Brown বিষয়বস্তুগত পার্থক্য করতে গিয়ে বলেছেন, অর্থনীতি আলোচনা করে বিষয়-সম্পত্তিকে নিয়ে, অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা রাজনীতি আলোচনা করে মানুষকে নিয়ে।

৭. সমস্যার সমাধান: অর্থ বিজ্ঞানীরা কেবল অর্থনৈতিক সূত্রাদি নির্দেশ করেন ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সূত্রগুলোর কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে থাকেন। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাষ্ট্র সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে চিন্তাভাবনা করেন। এ কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা ক্ষেত্র অধিকতর বিস্তৃত।

৮. নীতিগত: নীতিগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অর্থনীতির আলোচনা মূল্যমান নিরপেক্ষ। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা মূল্যমান নিরপেক্ষ নয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, উভয়ের মধ্যে মৌলিক কিছু পার্থক্য থাকলে এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। উভয়েই বিশেষভাবে সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ জনগণের পক্ষে কথা বলে। তবে উভয়ের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান।