ভারতের শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, ভারতের শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি বর্ণনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: ১৯২০ সাল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। খিলাফত আন্দোলনের পাশাপাশি এ বছর মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন। এর মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে একদিকে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেয়। এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে অসহযোগ আন্দোলনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভারতের শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে এর ভূমিকা: ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে অসহযোগ আন্দোলন সংঘটিত হয় তা ছিল ভারতীয় জনসাধারণের ঘৃণা, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এগুলো ছাড়াও প্রত্যক্ষ কিছু কারণ এবং ঘটনাও দায়ী ছিল। নিম্নে অসহযোগ আন্দোলন ভারতের শাসনতান্ত্রিক দিকগুলো তুলে ধরা হলো:

১. তুরস্কের পতন ও ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ: অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল তুরস্কের পতন এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের প্রতিশ্রুতি দেয় যে, যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন তুরস্কের সীমানাকে অখণ্ড রাখা হবে এবং খিলাফতের উপর কোনো আঘাত হানা হবে না। কিন্তু তুরস্ক যুদ্ধে পরাজিত হলে ব্রিটিশ সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। ফলে মুসলমানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে লিপ্ত হয়।

২. রাওলাট অ্যাক্ট: ভারতীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালে আইন পাস করতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ সরকার সত্যাগ্রহ আন্দোলন চিরতরে দমন করার জন্য ভারত প্রতিরক্ষা বা রাওলাট অ্যাক্ট পাস করেন। এ আইন পর্যালোচনার জন্য একটি যাচাই কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির রিপোর্টে বলা হয় যে, ক. এ আইনের দ্বারা জরুরি অবস্থায় যে কোনো মামলার বিচারক ছাড়াই নিষ্পত্তি করা হবে। খ. সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের জেলে দেয়া হবে। ফলে এ দমনমূলক আইন বাতিলের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে উঠে।

৩. জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড: রাওলাট আইনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের গুলিতে নিহতদের উদ্দেশ্যে ১৩ এপ্রিল ১৯১৯ সালে প্রায় দশ হাজার লোক অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগের এক সভায় মিলিত হয়। এসময় সভা সমিতি ও মিছিল শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সভায় জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে সৈন্যদের গুলিতে শত শত লোক হতাহত হয়। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।

৪. অধিকতর স্বরাজ লাভের আকাঙ্ক্ষা: ব্রিটিশদের একচেটিয়া আধিপত্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতবাসী সোচ্চার হয়ে উঠে। তারা স্বরাজ পার্টির নেতৃত্বে পৃথক নির্বাচন দাবি করে আন্দোলন শুরু করে। ১৯২০ সালের শেষের দিকে কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে স্বরাজ লাহরে আশায় অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব উত্থাপন করে। মহাত্মা গান্ধী প্রতিশ্রুতি দেয়, যদি ভারতীয় জনগণ তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে তাহলে ভারতবাসী এক বছরের মধ্যে স্বরাজ লাভকরবে। স্বরাজ লাভের আকাঙ্ক্ষায় গান্ধীজীর প্রস্তাবনা অসহযোগ আন্দোলনের বাস্তব ক্ষেত্র তৈরি করে।

৫. উপনিবেশের উপর অত্যাচার এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা: ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের শাসক গোষ্ঠী দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালায়। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার এশিয়াটিক সংশোধনী আইন প্রবর্তন করে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয়দের সংঘদ্ধ করে এবং প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। যার ফলে সংঘটিত হয় অসহযোগ আন্দোলনের।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলন এক যুগান্তকারী ঘটনা। এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ভারতবাসীকে পরবর্তীতে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি গঠনে সহযোগিতা করেছিল। এ আন্দোলন ছিল ভারতবাসীর একমাত্র উদ্দীপনা ও আত্মোৎসর্গ। গান্ধীজী এ আন্দোলনকে আত্মশক্তি ও বৈষয়িক শক্তির মধ্যে এ আন্দোলন বলে অভিহিত করেনে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, অসহযোগ আন্দোলন ছিল ভারতীয় জনসাধারণের জন্য একটি সচেতনতাবোধ জাগ্রত করার আন্দোলন। ঐ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করে ভারতবাসী অনেকটা জাতীয় চেতনাসম্পন্ন হয়ে উঠে।