অথবা, ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হওয়া যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে তুরস্কের খিলাফত ব্যবস্থাকে অক্ষুণ্ণ ও তুরস্ক সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য ভারতীয় মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে খিলাফত আন্দোলন শুরু করে। আর কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী খিলাফত আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। তবে এ দুইটি আন্দোলন ব্যর্থ হলেও ভারতের শাসনতান্ত্রিক তথা রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনে ও খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন ভূমিকা: ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের গঠন প্রকৃতি ও গুরুত্ব বা তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে দেয়া যায় যে, রাজনৈতিক বির্বতনের ইতিহাসে এ উভয় আন্দোলনের যেমনি কিছু ইতিহাসে ভূমিকা ছিল তেমনি নেতিবাচক ভূমিকা ছিল।
ইতিবাচক ভূমিকা : রাজনৈতিক বির্বতনের ইতিহাসে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ইতিবাচক ভূমিকা নিম্নরূপঃ
১. বৃহত্তর আন্দোলনের অভিজ্ঞতা: জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ ঢাকা ও কলকাতায় গণআন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণ এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ততা ঘোষণা করে। ভারতের জনগণ খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বৃহত্তর আন্দোলনের অভিজ্ঞতা অর্জন করে।
২. কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি: এ আন্দোলনের ফলে জাতীয় কংগ্রেসের শক্তি ও প্রচার বৃদ্ধি পায় এবং কংগ্রেসে সুসংবদ্ধ ও সুনিয়ন্ত্রিত সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভকরে। এছাড়! এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কংগ্রেস প্রথম ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
৩. ভারতবাসীর রাজনেতিক চেতনার বিকাশ : খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার জনগণ সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের উৎসাহ উদ্দীপনা ও শিক্ষা লাভকরে। এ আন্দোলন ছিল প্রথম নিরস্ত্র ভারতবাসীর শক্তিতে বলীয়ান ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ সংগ্রাম।
৪. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে সাময়িক কালের জন্য হলেও হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বৃদ্ধি পায়। ১৯২০ সালে ১৯ মার্চ ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
৫. ব্রিটিশ শাসকশ্রেণির নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি: খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন ব্রিটিশ শাসক শ্রেণির নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সছি করে। এ আন্দোলন থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে বিটিশরা শাসনকার্যে নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করে। ইংরেজদের মনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংশয়ের উদ্ভব হয়।
৬. স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা সৃষ্টি: যৌথভাবে এ উভয় আন্দোলনের স্রোতধারা ভারতীয়দের পরাধীনতা থেকে মুক্তির অনুপ্রেরণা দান করে। এ আন্দোলন ভারতীয়দের মনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায় যা ভারতীয়দের মনে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা সৃষ্টি করে।
নেতিবাচক ভূমিকা: খিলাফত ও
ইতিবাচক ভূমিকার সাথে কিছু নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। অসহযোগ আন্দোলনে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের নেতিবাচক ভূমিকা নিম্নরূপ:
১. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বাধাগ্রস্ত: খিলাফত ও বাধাগ্রস্ত হয়। অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ব্যর্থ হওয়ায় কারণে ভারতীয়দের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ব্যাপকভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভারতীয়দের স্বাধীনতা অর্জনের পথ দুরস্থ হয়েছিল।
২. জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বাধাগ্রস্ত: খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সাথে ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনও বাধাগ্রস্ত হয়। আন্দোলনে নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সমঝোতার অভাব দেখা দেয়। ফলে হিন্দু মুসলিম সম্পর্কে ফাটল ধরায় ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
৩. হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট: মহাত্মা গান্ধী হঠাৎ করে অসহযোগ আন্দোলনের প্রত্যাহার ঘোষণা করে। ফলে মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে হিন্দু- মুসলিম দেখা দাঙ্গা দেয়। ফলশ্রুতিতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বিনষ্ট হয়।
৪. কংগ্রেসে ভাঙ্গন সৃষ্টি: প্রথমে কংগ্রেস ছিল একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল। কিন্তু ক্রমেই কংগ্রেস তার আর্দশ থেকে বিচ্যুত হতে থাকে। এছাড়া খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হলে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। গান্ধীজীর আইনসভা বর্জন নীতির প্রতিবাদে চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহেরু প্রমুখ নেতা কংগ্রেস ত্যাগ করে। স্বরাজ পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। ফলে উভয় আন্দোলন ব্যর্থ হয় তথাপি ভারতের শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রেও আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা যা যায়। আন্দোলনের ফলে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও হিন্দু মুসলিম ঐক্য স্থাপিত হয়। রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। বৃহত্তর আন্দোলনের অভিজ্ঞতা প্রভৃতি পরবর্তী বৃহত্তর স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুপ্রেরণা বুঝিয়েছিল। ভারতের শাসনতান্ত্রিক তথা রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাসে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ভূমিকা অপরিসীম।