বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণের উপায় আলোচনা কর।

অথবা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার উপায়সমূহ বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে লর্ড ব্রাইসের অভিমত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিছি বলেছেন, কোন দেশের সরকারের কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে তার বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা। আর এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণের উপায়: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা যেসব কার্যকারণের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় এবং যেসব পন্থা অনুসৃত হলে বিচারকগণ নির্ভয়ে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেগুলো নিম্নরূপ:

১. সুষ্ঠু নিয়োগ পদ্ধতি অবলম্বন: স্বাধীন বিচার বিভাগের সুষ্ঠু ভূমিকা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে নিয়োগ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে নিয়োগ করা হয়। যথা:

ক. আইনসভা কর্তৃক (Election by the legislature),

খ. জনগণ কর্তৃক (Election by the people) এবং

গ. প্রধান নির্বাহী কর্তৃক (Nomination by the chief executive)।

আইনসভা ও জনগণ কর্তৃক বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি জটিল ও কঠিন এবং তা থেকে প্রত্যাশিত ফল আশা করা যায় না। তাই বর্তমানে প্রধান নির্বাহী কর্তৃক বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে। যোগ্যতম বিচারক নিয়োগের এটাই হচ্ছে উত্তম উপায়। তবে প্রধান নির্বাহী যদি বিচারপতিদের নিয়োগের ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় মন্ত্রী এবং বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটির সুপারিশক্রমে নিয়োগ দান করেন তাহলে আর কোন প্রকার অসুবিধা থাকে না।

২. বিচার বিভাগ কর্তৃক নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ: বিচার বিভাগ নাগরিকদের পৌর অধিকার এবং সংবিধানে সন্নিবেশিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষা করে ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিচার বিভাগ নাগরিকদের উপর্যুক্ত অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করতে গিয়ে কয়েকটি বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করে। এ পদ্ধতিসমূহ নিম্নরূপ:

ক. হেবিয়াস কর্পাস (Habeas corpus),

খ. ম্যানডেমাস (Mandamus),

গ. সার্সিওয়ারি (Certioari) এবং

ঘ. কোয়ারেন্টো (Quowarranto)

এ রিট আবেদন বা হুকুমনামাসমূহ জারি করার ক্ষমতা বিচার বিভাগের রয়েছে। এদের মাধ্যমে অধিকার বঞ্চিত যে কোন ব্যক্তির আবেদনক্রমে বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে বিচারের জন্য আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিতে পারে।

৩. বিচার বিভাগের স্বতন্ত্রীকরণ: অধ্যাপক লাঙ্কি মন্তব্য করেছেন, “The independence of the judiciary is essential to freedom. In that sense the doctrine of separation of powers enshrines permanent truth.” তাঁর মতে, শাসকের হাতে বিচারের ভার ন্যস্ত থাকলে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। এরকম ক্ষেত্রে শাসন বিভাগ সহজেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আইন ও শাসন বিভাগ থেকে তার স্বতন্ত্রীকরণ অপরিহার্য।

৪. বিচারকদের কার্যকাল: বিচারপতিদের কার্যকালের স্থায়িত্ব তাঁদের নির্ভীকভাবে দায়িত্ব পালনে সাহায্য করে। কার্যকালের স্থায়িত্বের অভাবে তাঁদের পক্ষে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। কার্যকালের মেয়াদের অনিশ্চয়তা, অপসারণের পদ্ধতির নমনীয়তা, বিচারপতিদের শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং রাজনৈতিক পদাধিকারীদের উপর নির্ভরশীল করে তোলে। বিচারকদের পদচ্যুতি করার ক্ষমতা কোন অবস্থাতেই শাসন বিভাগের উপর ন্যস্ত করা উচিত নয়। কেবলমাত্র বিচার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তাঁদের মারাত্মক চারিত্রিক দোষ প্রমাণিত হলে বিচারকদের কার্যকাল এবং চাকরির পদচ্যুতি করা যাবে।

৫. অবসর গ্রহণের পর আদালতে ওকালতি বন্ধের ব্যবস্থা: বিচারপতিদের অবসর গ্রহণের পর কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের অধীনে তাঁদের ওকালতি নিষিদ্ধ করা উচিত। অবসর গ্রহণের পর আদালতে ওকালতি করলে বা কোন কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করলে বিচার বিভাগের রায় ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার জন্য পূর্বতন পরিচয় ও প্রভাবকে তাঁরা প্রয়োগ করতে পারেন। বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখতে হলে অবসর গ্রহণের পর তাঁদের সরকারি ও বেসরকারি পদে নিয়োগ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা উচিত।

৬. বিচারপতিদের কাজের সমালোচনা: বিচারপতিদের কাজের সমালোচনার উপর বাধানিষেধ আরোপ করা দরকার। বিচারপতিদের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে নির্ভীকভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়।

৭. বিচারপতিদের ব্যক্তিগত গুণাবলি: বিচারপতিদের ব্যক্তিগত গুণাবলি, চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা এবং মর্যাদা রক্ষার মাধ্যম রূপে কাজ করে। তাদের আচার আচরণ আদালতের মর্যাদা বৃদ্ধির অনুকূল হওয়া প্রয়োজন। বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে বিচারপতিদের মানসিক বিচার করা অত্যন্ত জরুরি। সমাজের সদস্য হিসেবে বিচারপতিগণ সমাজে বিদ্যমান কোন না কোন মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকেন। সুতরাং নিজেদের মূল্যবোধকে বর্জন করে তাঁদের পক্ষে রায় ঘোষণা করা সম্ভব নয়।

৮. বিচারকদের পদোন্নতি: বিচারকদের কর্মক্ষমতা নির্ভর করে তাঁদের কর্মসম্পাদনের ইচ্ছার উপর। এ ইচ্ছা আবার নির্ভর করে মূলত পদোন্নতির আশার উপর। কাজেই বিচারকদের পদোন্নতির বিষয়টি অতি যত্নের সাথে বিবেচনা করা উচিত। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ নীতির ভিত্তিতেই পদোন্নতি হওয়া বাঞ্ছনীয়; তবে বিশেষ কোন ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা এবং মেধাও পদোন্নতির ভিত্তি হতে পারে।

৯. চাকরি থাকাকালীন সুযোগ সুবিধা: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিচারকদের উচ্চতম বেতন ও ভাতার সুব্যবস্থা, চাকরিতে থাকাকালীন চাকরির স্থায়িত্ব প্রদান এবং উচ্চহারে অবসরজনিত ভাতার সুব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। বেতনের পর্যাপ্ততা এবং নিরাপত্তা বিচারকদের সঠিকভাবে কর্তব্য সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করে। এ দিকটির উপর
লক্ষ্য রেখে অধিকাংশ রাষ্ট্রই বিচারকদের বেতনাদি এবং চাকরির শর্তাবলি সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে থাকে।

১০. বিচারকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বিচারকদের পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেক সময় বিচারকগণ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকাংশে কমিয়ে ফেলে।

১১. লিখিত সংবিধান: সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন, যার মাধ্যমে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। যদি বিচারকেরা লিখিত সংবিধানের ধারা অনুযায়ী রায় দেয় তাহলে জনগণের মধ্যে রায় সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি থাকবে না। তাই লিখিত সংবিধানও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সংকীর্ণ আইনানুগ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রত্রিনয়ার একটি অংশ। সে কারণেই বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। এজন্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্কি (Laski) বলেন, “বিচার ব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রদর্শন নিরপেক্ষ হতে পারে না।”