অথবা, সংসদীয় সরকার ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বৈপরীত্য দেখাও।
উত্তর: ভূমিকা: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের নীতির উপর ভিত্তি করে বা শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের প্রকৃতি অনুসারে আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকারসমূহকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা: পার্লামেন্টারীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। উভয় সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দু’টি রূপ। যে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষমতা যখন রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়, রাষ্ট্রপতি যখন আইনসভার পরিবর্তে জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন এবং তার কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকেন না তাকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার বলে। যে শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা শাসন ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের কাজের জন্য আইনসভার নিকট দায়ী থাকে তাকে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বা সংসদীয় সরকার বলে।
সংসদীয় সরকার ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য : নিয়ে সংসদীয় সরকার ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হল:
১. মন্ত্রিসভার ক্ষেত্রে পার্থক্য: মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মন্ত্রিসভার শীর্ষ নেতা হিসেবে একজন প্রধানমন্ত্রী থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুসারেই দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির নিকট দায়িত্বশীল থাকে।
২. নমনীয়তার ক্ষেত্রে: মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থা সাধারণত নমনীয় হয় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সংগতি সাধন করতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা সাধারণত অনমনীয় হয় এবং সহজে পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে না।
৩. আইনসভার প্রাধান্য: তত্ত্বগতভাবে মন্ত্রিপরিষদ শাসনব্যবস্থায় পার্লামেন্ট বা আইনসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. স্থায়িতের ক্ষেত্রে: সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার স্থায়ী হয় না। দেশে বহুদলীয় ব্যবস্থা বর্তমান থাকলে ঘন ঘন সরকার পরিবর্তনের আশঙ্কা থাকে। তাই মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার স্থায়ী হয়। তাই এ সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবে কার্যকর করতে পারে।
৫. জরুরি অবস্থা: মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে উপযোগী নয়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাই জরুরি অবস্থায় দ্রুত এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি দ্রুত এবং দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। তাই এ সরকার জরুরি অবস্থার উপযোগী।
৬. সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষেত্রে: মন্ত্রিপরিষদ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর দলের সদস্যরাই আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। তা না হলে মন্ত্রিসভা ক্ষমতাসীন থাকতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি যে রাজনৈতিক দলের সদস্য, দেশের আইনসভায় সে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও থাকতে পারে।
৭. স্বৈরাচারিতার ক্ষেত্রে: মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগের স্বৈরাচারী হওয়ার ভয় থাকে না। পক্ষান্তরে, রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ স্বৈরাচারী ও একনায়ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৮. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ: আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ পার্লামেন্টারীয় শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভার সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে মনোনীত হন। কিন্তু আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ব্যাপক প্রয়োগের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় বলেই এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ পরস্পর নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকে। শাসন বিভাগের প্রধান রাষ্ট্রপতি আইন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আইন বিভাগও তেমনি রাষ্ট্রপতিকে প্রভাবিত করতে পারে না।
৯. পদচ্যুত করার ক্ষেত্রে: মন্ত্রিসভার কার্যকাল আইনসভার সদস্যদের আস্থার উপর নির্ভরশীল। আইনসভার অধিকাংশের আস্থা হারালে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাকে পদত্যাগ করানো যায় না। কেননা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তিনি জনগণ কর্তৃক মনোনীত হন।
১০. কার্যক্রমের ক্ষেত্রে: মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিগণ আইনসভার কাজে অংশ নেন। তারা আইন প্রণয়নের কাজে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি বা মন্ত্রিগণ আইনসভার কাজে অংশ নেন না। তারা আইন প্রণয়নের কাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের যেমন কতকগুলো গুণ আছে তেমনি এর বহুবিধ ত্রুটিও রয়েছে। তবে বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা খুবই ফলপ্রসূ। আর উন্নত রাষ্ট্রের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকারিতা লাভ করে।