সার্বভৌমত্বের একত্ববাদের মূলকথা আলোচনা কর।

অথবা, সমালোচনাসহ সার্বভৌমত্বের একত্ববাদ তত্ত্বটি বর্ণনা কর।

অথবা, সার্বভৌমত্বের একত্ববাদ উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্র গঠনের প্রধান চারটি উপাদান হলো সার্বভৌমত্ব, জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও সরকার। এ উপাদানগুলোর মধ্যে সার্বভৌমত্ব অন্যতম উপা দান। সার্বভৌমত্ব ছাড়া কোন রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। সার্বভৌমত্ব ধারণাটি আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি। সার্বভৌমত্ব অর্জন না করলে যেমন রাষ্ট্র গঠিত হয় না, তেমনি সার্বভৌমত্বের বিলুপ্তির সাথে সাথে রাষ্ট্রেরও বিলুপ্তি ঘটে। সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে Prof. Miller বলেছেন, “We must recognise the sovereignty state as the prime fact of political life.”

সার্বভৌমিকতার একত্ববাদের মূলকথা: সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত ‘একত্ববাদ’ বা ‘পরম্পরাগত’ মতবাদ বলতে আইনসঙ্গত মতবাদকে বুঝায়। একত্ববাদের মূলকথা হলো যে, সার্বভৌমিকতা চরম, অবাধ ও অসীম। সার্বভৌমিকতা এক ও অবিভাজ্য। এ মতবাদে সার্বভৌমিকতার কেন্দ্রীয়করণ ও রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতার কথা বলা হয়। রাষ্ট্র তার এলাকার মধ্যে সকল ব্যক্তি ও ব্যক্তি সংঘের উপর অপ্রতিহত ও চরম ক্ষমতা প্রয়োগ করে। রাষ্ট্র হলো সার্বভৌম। রাষ্ট্রের আদেশই হলো আইন। এ আইন অমান্য করলে রাষ্ট্র আইন অমান্যকারীর উপর আইনানুসারে বলপ্রয়োগ করতে পারে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, রাষ্ট্র ও তার সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে একত্ববাদীদের বক্তব্যের মধ্যে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এ পার্থক্যের ভিত্তিতে একত্ববাদকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়; যথা:

ক. তত্ত্বগত (Abstract)

খ. বাস্তব (Concrete)।

ক. তত্ত্বগত একত্ববাদ: তত্ত্বগত একত্ববাদ অনুযায়ী সার্বভৌমিকতা একমাত্র রাষ্ট্রের হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে। রাষ্ট্র হলো এক ও অদ্বিতীয়। রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে অন্য কোন সংঘের অস্তিত্ব অস্বীকৃত। এ শ্রেণির বিশ্লেষকগণের মতানুসারে রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের ভিতরে অন্য কোন সংঘ থাকলে অনৈক্যের সৃষ্টি হবে। এ কারণে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের স্বার্থে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল প্রকার সংঘের অস্তিত্বের অবলুপ্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।

খ. বাস্তব একত্ববাদ: বাস্তব একত্ববাদে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের সংঘের অস্তিত্ব ও তাদের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা হয় না। কিন্তু এসব সংঘের উপর রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের অস্তিত্ব এবং তার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। একমাত্র রাষ্ট্রেরই সার্বভৌমিকতা আছে। অন্য কোন সংঘের তা নেই। রাষ্ট্রের এ সার্বভৌমিকতা হলো অভিন্ন, অবিভাজ্য ও চরম। সেজন্য রাষ্ট্র তার এলাকার ভিতরে চরম ও অপ্রতিহত কর্তৃত্বসম্পন্ন। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে সকল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংঘ তার সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য থাকে।

একত্ববাদের সমালোচনা: একত্ববাদকে বহুত্ববাদীরা ৩টি দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করেছেন-

১. কাঠামোর দিক থেকে: একত্ববাদিগণ রাষ্ট্র ও সমাজকে অভিন্ন মনে করেন। কিন্তু বহুত্ববাদীদের মতে রাষ্ট্র ও সমতা অভিন্ন নয়। ব্যক্তির আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাষ্ট্রকে প্রদান করা উচিত। কোল ও হবসনের মতে, “রাষ্ট্র মানব সৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান।” সুতরাং রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার মানুষের রয়েছে।

২. আইনের দিক থেকে: ক্র্যাবে, দ্যুগুই বহুত্ববাদীগণ মনে করেন, রাষ্ট্র আইনের একমাত্র উৎস নয়। রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বেও আইনের অস্তিত্ব ছিল। আইন প্রণয়নের দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত না করে সামাজিক সংঘ বা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপরই অর্পণ করা উচিত।

৩. সীমাবদ্ধতা: বহুত্ববাদীদের মতে, রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয়ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ। বর্তমানে বিশ্বে কোন রাষ্ট্রই বাহ্যিক ক্ষেত্রে সার্বভৌম কর্তৃত্বসম্পন্ন নয়। কারণ, কোন রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক আইন বা প্রথাকে উপেক্ষা করতে পারে না।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সামাজিক বিজ্ঞানের কোন তত্ত্বই সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিমুক্ত কিংবা সমালোচনা মুক্ত নয় একথা হলফ করে বলা যায়। আধুনিক রাষ্ট্রতান্ত্রিক বিশ্বে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণা নিয়ে একত্ববাদীদের যেমন রয়েছে বিভিন্ন যুক্তি, তেমনি রয়েছে তাদের অনেক সমালোচনা; যার ফলশ্রুতিরূপে এসেছে সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী ধারণা। সে যাহোক, আমরা দু’টি তত্ত্ব ও বিশ্লেষকগণের মতামত পর্যালোচনা করে, একথা বলতে পারি যে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে সার্বভৌম বা চূড়ান্ত ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রেরই আছে এবং রাষ্ট্রেরই থাকা উচিত। এদিক থেকে বিবেচনা করলে সার্বভৌমত্বের একত্ববাদই গুরুত্বের দাবিদার।