অথবা, সার্বভৌমত্বই হলো রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন কর্তৃপক্ষ- ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সার্বভৌমত্বের আদেশই আইন’ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর: ভূমিকা: আইন হচ্ছে কতকগুলো নিয়ম ও বিধিবিধানের সমষ্টি যা প্রত্যেকটি ব্যক্তি মান্য করতে বাধ্য থাকে। সমাজব্যবস্থার অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ। মানুষের বাহ্যিক ব্যাপারে আচরণের যে নিয়মাবলি সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ স্বীকৃত তাই আইন। আইনের নির্দিষ্ট কোন উৎস নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎস এবং পদ্ধতির মাধ্যমে আইনের উদ্ভব হয়। আইনের এ উদ্ভবের পিছনে সার্বভৌম শক্তির ঘোষণা যেমন একটি -বলিষ্ঠ উপাদান হিসেবে কাজ করে; তেমনি আইনকে বৈধতা দানে সমাজ ও ব্যক্তির নৈতিকতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ক. সার্বভৌসের ঘোষণাই আইন বিশ্লেষণপন্থিরা রাষ্ট্রকে আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে আইন ও রাষ্ট্রের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। ফরাসি দার্শনিক বোঁদার মতানুসারে আইন হলো শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নির্দেশ এবং আইন বলবৎ হয় বলপ্রয়োগের দ্বারা।”
বেস্থামের মতে, “সার্বভৌম কর্তৃত্বের আদেশই হলো আইন এবং জনগণের কর্তব্য হলো সে আইনের প্রতি সাধারণ আনুগত্য প্রদর্শন করা।”
ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস্ও সার্বভৌম কর্তৃত্বসম্পন্ন রাজার আদেশ বা নির্দেশকে আইন হিসেবে প্রচার করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীতে প্রখ্যাত ইংরেজ আইনবিদ জন অস্টিন আইনকে অধস্তনের প্রতি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ বলে বর্ণনা করেছেন।
এরূপ আদেশের পিছনে চরম কর্তৃত্বের সমর্থন থাকে বলে অধস্তন ব্যক্তিবর্গ সে আদেশ উপেক্ষা বা অমান্য করতে সাহস পায় না।
বিশ্লেষণপন্থিদের মতামত পর্যালোচনা করলে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়:
১. রাষ্ট্র আইনের ঊর্ধ্বে : বিশ্লেষণপন্থিদের মতে রাষ্ট্র বা সার্বভৌম শক্তি সৃষ্টির পর আইন সৃষ্টি হয়েছে। রউন্ন আইনের জন্ম দিয়েছে। এদিক থেকে রাষ্ট্র আইনের উর্ধ্বে এবং প্রত্যেকের উচিত রাষ্ট্রের আদেশ মান্য করা।
২. আইন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত ও প্রযুক্ত: রাষ্ট্র কর্তৃক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রই আইম বাস্তবায়ন করে। আইন অমান্য করলে শাস্তি পেতে হয়। তাই নাগরিকগণ শাস্তির ভয়ে আইন অমান্য করতে বাধ্য হয়।
আইনের উদ্ভব ও বিকাশে বিশ্লেষণমূলক মতবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, কিন্তু এ মতবাদের বিরুছে উত্থাপিত সমালোচনাগুলোও অনেক বেশি। নিম্নে তা দেয়া হলো:
১. গণতন্ত্র বিরোধী: “সার্বভৌমের আদেশই আইন” এ ধারণাই গণতন্ত্র বিরোধী। আইনের সৃষ্টি ও সাফল্যের ব্যাপারে জনগণের ইচ্ছা ও সমর্থনের কার্যকর ভূমিকা রয়েছে। যা এ মতবাদের মাধ্যমে অস্বীকার করা হয়েছে।
২. আইন মান্য করার কারণ: এ মতবাদ অনুসারে মানুষ কেবল শাস্তির ভয়ে আইন মান্য করে। কিন্তু বাস্তবে মানুষ কেবল শান্তির ভয়েই আইন মান্য করে না। অন্য উপাদানগুলোও আইন মান্য করতে সাহায্য করে। এ সম্পর্কে লর্ড ব্রাইস বলেন, আইন মান্য করার কারণ হলো নির্লিপ্ততা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, শাস্তির ভয় ও যৌক্তিকতার উপলব্ধি।
৩. ভ্রান্ত ধারণা: শুধু সার্বভৌম শক্তিই আইনের উৎস হতে পারে না। আইন সৃষ্টি হতে হলে আরও অনেক উৎস রয়েছে। যাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।
৪. প্রথাগত বিধান উপেক্ষিত: প্রথা ও রীতিনীতি আইন প্রণয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। “সার্বভৌমের আদেশই আইন” এ ধারণার দ্বারা প্রথা ও রীতিনীতি উপেক্ষিত হয়েছে। ব্রিটেনের আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সেখানকার আইনের প্রধান উৎস হচ্ছে প্রচলিত প্রথা ও পদ্ধতি। সুতরাং এদিক দিয়ে বিশ্লেষণবাদীদের বক্তব্য সঠিক নয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, একটি রাষ্ট্রের আইন তৈরি করতে হলে সার্বভৌম শক্তির প্রভাব থাকে কিন্তু নৈতিকতা বিবর্জিত আইন কোন সমাজেই টিকে থাকতে পারে না। সুতরাং আলোচনা শেষে বলা যায় যে, শুধু ‘সার্বভৌমের ঘোষণাই আইন, এর চেয়ে আইনের ভিত্তি হচ্ছে নৈতিকতা।” এ বক্তব্যই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। এজন্যই Ivor Brown বলেন, “নীতিশাস্ত্রের ধারণাকে উপেক্ষা করলে রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদকে অর্থহীন, আবার রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ ব্যতিরেকে নৈতিক মতবাদ অসম্পূর্ণ।”