আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক আলোচনা কর। জনগণ আইন মান্য করে কেন?

অথবা, আইন ও নৈতিকতার মধ্যে সম্পর্ক বর্ণনা কর। জনগণের আইন মান্য করার কারণ আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: আইন ও নৈতিকতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ একে অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখেছেন। আবার কেউ কেউ দু’টি ভিন্ন বিষয় হিসেবে দেখেছেন। রাষ্ট্রের আইন ছাড়াও সমাজব্যবস্থার কতকগুলো বিধিবিধান থাকে, যার দ্বারা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়। মানুষের বিবেকবোধ, ন্যায়নীতি, ঐতিহা-অনৈতিহ্যের ধারণার উপর এসব বিধিবিধানের সৃষ্টি হয়। এগুলোকে নৈতিকতা বলা হয়। প্রাচীন যুগে আইনসমূহ নৈতিকতা নির্ভর ছিল কিন্তু যোড়শ শতাব্দীতে ইতালির চিন্তানায়ক মেকিয়াভেলি রাজনীতি থেকে নৈতিকতাকে পৃথক করেছেন। তারপরও আইন ও নৈতিকতার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এরা একে অপরের পরিপূরক। তাই Prof. Gettell বলেছেন, “There is a close connection between law and morals.”

আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক : নিয়ে আইন ও নৈতিকতার মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করা হলো:

১. উৎপত্তির দিক থেকে: উৎপত্তিগত দিক থেকে আইন ও নৈতিকতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নৈতিকতা বর্জিত কোন আইন কার্যকরী করা কঠিন। রাষ্ট্র মূলত একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রকে এমন আইন রচনা ও প্রবর্তন করতে হয়, যা নীতি ধর্মের অনুকূলে। উভয়ই বিভিন্ন রকম প্রথা, ধর্ম এবং ন্যায়বোধকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।

২. আইন নৈতিকতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই সমাজ এবং জীবনকে সমৃদ্ধি দান করে: আইন ও নৈতিকতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেই সমাজজীবনের উৎকর্ষতা সাধিত হয়। মানুষের নৈতিকতা যদি উন্নতমানের না হয়, তাহলে কোন রাষ্ট্রের আইন উন্নত মানের হতে পারে না। সুতরাং, আইন ও নৈতিকতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।

৩. এটা একে অপরকে প্রভাবিত করে: ন্যায়অন্যায় থেকে যেমন অনেক আইন সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে অনেক সামাজিক কুর্নীতিও আইনের দ্বারা দূরীভূত হয়েছে। যেমন- সতীদাহ প্রথা। ব্রিটিশ সরকার আইনের দ্বারা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেছিলেন। এ কারণেই মানুষ সহজে আইন মেনে নেয়। তবে কুপ্রথাগত নীতি আইনের মাধ্যমে সংশোধিত হয়।

৪. আইন ও নৈতিকতা উভয়েই পরিবর্তনশীল : সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে আইন ও নৈতিকতার পরিবর্তন ঘটে থাকে। যেমন- কোন এককালে নারী শিক্ষা নৈতিকতা বিরোধী ছিল, কিন্তু কালের ক্রমবিবর্তনে নারী শিক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে নৈতিকতার পরিবর্তন ঘটেছে।

৫. আইন ও নৈতিকতা পরস্পর নির্ভরশীল: আইন ও নৈতিকতা পরস্পর নির্ভরশীল। নৈতিকতার সাথে সম্পর্কহীন আইন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। অপরদিকে, আইন নৈতিকতাকে সাহায্য করে। যেমন- মদ ও জুয়া নৈতিকতা বিরোধী। আইনের দ্বারা এগুলো নিষিদ্ধ করা হয়। সুতরাং আইন ও নৈতিকতা পরস্পর নির্ভরশীল।

জনগণ আইন মান্য করে কেন বা মান্য করার কারণ: রাষ্ট্র পরিচালনায় আইন যেমন প্রয়োজন, তেমনি মানবজীবনে সভ্যতা ও সুশৃঙ্খলা আনয়নও অত্যাবশ্যক। আইন জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে, জনগণের স্বার্থেই কাজ করে। তাই আইন মান্য করায় পিছনে বেশকিছু যৌক্তিক কারণও রয়েছে। নিম্নে আইন মান্য করার কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

১. অধিকার সংরক্ষণের জন্য: উন্নত জীবনের জন্য রাষ্ট্র মানুষকে কতকগুলো অধিকার ভোগের সুযোগ প্রদান করে থাকে। আইন না থাকলে এসব অধিকার নির্বিঘ্নে ভোগ করা সম্ভব হয় না। অধিকার সংরক্ষণ ও ভোগের জন্য আইন মান্য করা হয়।

২. ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য: সুখশান্তি ও নিরাপত্তার অভাব হলে মানুষ তার মানবিক গুণাবলি ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের সুযোগ পায় না। ফলে সভ্যতা, সমৃদ্ধি ও প্রগতি ব্যাহত হয়ে থাকে। তাই ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য আইনকে মান্য করতে হয়।

৩. বিবেকবুদ্ধির প্রেরণায় : মানুষ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন জীব। বিবেকবান ব্যক্তি ন্যায় ও কল্যাণের পথে চলতে চায়। আইন ছাড়া এটা সম্ভব নয়। কাজেই বিবেকবুদ্ধির প্রেরণায় মানুষ আইন মেনে চলে।

৪. সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য: পরস্পর পরস্পরের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য অবশ্যই আইন মেনে চলতে হয়। কারণ একটা নির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমেই পরস্পর পরস্পরের কাছাকাছি অবস্থান করতে পারে।

৫. সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনার জন্য: সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করা প্রত্যেক মানুষের স্বপ্ন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই একটা নিয়মনীতি মেনে চলা দরকার। আর এ নিয়মনীতিই হলো আইন।

৬. শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি: মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব হিসেবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি মানুষকে আইন মান্য করতে সাহায্য করে।

৭. ধর্মীয় কারণ: অতি প্রাচীনকালে ধর্মভিত্তিক আইনের দ্বারা মানুষের জীবন পরিচালিত হতো। আইন অমান্য করা পাপ বলে বিবেচিত হতো। পাপের ভয়ে মানুষ আইন মেনে চলতো।

৮. ন্যায় প্রতিষ্ঠার তাগিদে: আইন দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন করে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে। আইন না থাকলে অন্যায়ে দেশ ছেয়ে যেতো, মানবসভ্যতা বিলুপ্ত হতো। কাজেই ন্যায় প্রতিষ্ঠার তাগিদে মানুষ আইন মেনে চলে ও আইনকে শ্রদ্ধা করে।

৯. সুখশান্তি ও নিরাপত্তার কারণ: আইন মেনে চললে রাষ্ট্রে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে। মানুষ সুখেশান্তিতে ও নিরাপদে বসবাস করতে পারে।

১০. শান্তির ভয়ে: আইন ভঙ্গ করা শান্তিমূলক অপরাধ। আইন অমান্য করলে রাষ্ট্র কর্তৃক শাস্তি পেতে হয়। তাই মানুষ আইন মেনে চলে ও আইনকে শ্রদ্ধা করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, আইন হলো একটি লিখিত বিধিবিধান, যা সকলের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। আইন তৈরি করার ।ময় ধর্ম, প্রথাগত বিধিবিধান ও একাধিক বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয়। তবে সকল রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা মিল থাকলেও পুরোপুরি এক নয়। রদ্র ও সরকার ব্যবস্থার ধরনের উপর ভিত্তি করে আইন প্রণীত হয়। আইন ও নৈতিকতার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।