অথবা, আন্তর্জাতিক আইনের অবদান বর্ণনা কর। বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করে বিশ্বশান্তি স্থাপনের দৃষ্টান্ত বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: বর্তমান যুগ আন্তর্জাতিকতার যুগ। আধুনিক বিশ্বে কোন রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ বা আত্মনির্ভরশীল নয়। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক প্রভৃতি বহুবিধ পারস্পরিক সম্পত্যেযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এ পারস্পরিক সম্পর্ক হবে নিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক আইন। আর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে নীতির মাধ্যমে সহযোগিতা নির্ধারিত হয় তাকে আন্তর্জাতিক আইন বলে।
বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক আইন: রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন করা হয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সার্বভৌমত্ব ও শান্তিশৃঙ্খলা প্রভৃতি রক্ষা করার জন্য। আর আন্তর্জাতিক আইনও অনুরূপভাবে বিশ্বরাষ্ট্রসমূহের শাস্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক আইনের ভূমিকা অত্যধিক। নিম্নে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক আইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. যুদ্ধ পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ: আন্তর্জাতিক আইন এর সৃষ্টির ফলেই যুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধের ইচ্ছাকে কিঞ্চিত পরিমাণে হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। যুদ্ধ হলো মানবসভ্যতা ও অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা। আর শক্তিশালী আন্ত জাতিক আইনই যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইনের বিধিমালা সভ্য দেশগুলোর সেনাবাহিনী দ্বারা যুদ্ধবন্দী, রোগাক্রান্ত এবং আহত যোদ্ধাদের প্রতি আচরণের মাত্রাকে অনেকাংশে উন্নত করেছে।
২. বিশ্বশান্তি ও শৃঙ্গলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে: আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আইনগত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় যথাযথ ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক আইনের অবর্তমানে আন্তর্জাতিক শান্তি ও শৃঙ্খলা অবশ্যই বিনষ্ট হবে। আন্তর্জাতিক আইনই ছায়ী বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বাস্তব ভিত্তিস্বরূপ।
৩. অস্ত্র প্রতিযোগিতা রোধ: আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমেই মানবজাতির অস্তিত্ব বিপন্নকারী অস্ত্র প্রতিযোগিতার অভাবনীয় প্রসার ও তার ধ্বংস লীলা বন্ধ করা সম্ভব। অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণকল্পে আইনের প্রয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক বিচারালয় কাজ করে যাচ্ছে।
৪. আন্তর্জাতিক সংগঠন সৃষ্টির ক্ষেত্রে: বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ ও বিশ্ব জনমত গঠনে আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় মানবকল্যাণ ও বিশ্বশান্তি সুনির্দিষ্ট করার লক্ষ্যে গঠন করা হয় জাতিসংঘ। আর আন্তর্জাতিক আইনের সুনির্দিষ্ট ধারা অনুযায়ী বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ কাজ করে যাচ্ছে।
৫. বিশ্ব রাজনীতিতে মর্যাদা ও সুনাম অর্জন: আন্তর্জাতিক আইন ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিধিসমূহ মান্য করলে আন্ত র্জাতিক সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় না। তাই আন্তর্জাতিক আইন মান্যকারী প্রতিটি রাষ্ট্রই বিশ্বে বিশেষ মর্যাদা ও সুনাম অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক আইন বিশ্ব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আনয়ন করে।
৬. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সমুন্নত রাখা: আন্তর্জাতিক আইনে ব্যাপক সংখ্যক বিধিমালা শান্তিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনায় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে নতুন বিধিবিধান ও দায়দায়িত্ব সংযোজিত হচ্ছে যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সমুন্নত রাখে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ চলাকালে আন্তর্জাতিক আইনের দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও আন্ত জাতিক আইনের স্বীকৃতির ফলে রাষ্ট্রগুলো কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বহীনতা অনেকাংশে হ্রাস করেছে।
৭. সন্ধি চুক্তি নিয়ন্ত্রণ: আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে সন্ধি চুক্তি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সন্ধির বিষয়বস্তু পারস্পরিক স্বার্থ সম্বলিত হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বশান্তি রক্ষায় সন্ধি চুক্তির ভূমিকা অপরিসীম। আন্তর্জাতিক বিষয়ে Vienna convention on the law of treatise 1969 অনুযায়ী বিভিন্ন রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক আইন বলে একাধিক চুক্তি সম্পাদন করতে পারে।
বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক আইনের অনুসরণ: আন্তর্জাতিক আইন পালন করা যদিও কোন রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক নয়, তবুও বিশ্বশান্তি শৃঙ্খলার স্বার্থে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক আইন পালন করে থাকে। বিশ্বের কয়েকটি দেশের আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক আইন: আন্তর্জাতিক আইন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত আইনের অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে আন্তর্জাতিক আইন গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বের সকল Convention সমূহকে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দান করেছে। আর আন্তর্জাতিক আইনকে রাষ্ট্রীয় আদালতে বলবৎ করার মানেই হলো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা।
২. গ্রেট ব্রিটেনে আন্তর্জাতিক আইন: গ্রেট ব্রিটেনে আন্তর্জাতিক আইনকে সাধারণ আইনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বিশেষ কতকগুলো নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের আদালতসমূহ আন্তর্জাতিক আইনের বিধিবিধান অনুসরণ করে থাকে।
৩. ভারতে আন্তর্জাতিক আইন: আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা ও রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ভারত সাধারণ আইনের মতোই আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ নিরসনে ভারত চেষ্টা চালায়।
৪. বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক আইন: বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদে কতকগুলো নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় সার্বভৌম ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক কলহের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা ইত্যাদি নীতিমালা হবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তিমূল।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে আন্তর্জাতিক আইন মান্য করা উচিত। আন্তর্জাতিক আইন বর্তমান বিবদমান বিশ্ব ব্যবস্থায় সকল রাষ্ট্র ও জনপদের স্বার্থ রক্ষায় অতুলনীয় ভূমিকা পালন করছে। তাই প্রতিটি রাষ্ট্রকেই আন্তর্জাতিক আইনের বিধিবিধানসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিপদগ্রস্ত বা অবনতির পথে ধাবিত হবে।