অথবা, “আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর নির্ভরশীল”-উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আইন ও স্বাধীনতার মধ্যকার সম্পর্ক বর্ণনা কর।
অথবা, আইন স্বাধীনতাকে খর্ব করে না, প্রসারিত করে।”-ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আইনের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্ট বিকাশ ও কার্যকলাপ কার্যকর করার জন্য আইনের প্রয়োজন অপরিহার্য। আইন ছাড়া সভ্য সমাজের কথা কল্পনাও করা যায় না। আইন হলো মানুষ, সমাজ তথা রাষ্ট্রের বিকাশের অন্যতম নিয়মনীতি। অধ্যাপক লাস্কি আইনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, “Law is those rules of behaviour which secure the purpose of the society.”
আইন স্বাধীনতার পূর্বশর্ত বা আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক বা আইন স্বাধীনতাকে খর্ব করে না, প্রসারিত করে: আইন স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং স্বাধীনতাকে সকলের নিকট সমানভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। আইন না থাকলে দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তির স্বাধীনতা বিপন্ন হতো। আইন মানুষের আচার আচরণ ও কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বলে প্রত্যেকে নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে থেকে কাজ করতে বাধ্য হয়। ফলে আইনের দ্বারা ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়। তাই বলা হয়, “আইন হলো স্বাধীনতার শর্ত।” (Law is the condition of liberty.) নিয়ে আইন স্বাধীনতার পূর্বশর্ত বা আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক বা আইন স্বাধীনতাকে খর্ব করে না, প্রসারিত করে এ সম্পর্ককে দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হলো:
ক. প্রথম দৃষ্টিকোণ: উইলিয়াম গডউইন (William Godwin), ক্রপটকিন (Croptkin), জে. এস. মিল (J. S. Mill), ডাইসী (Diecy), হার্বার্ট স্পেন্সার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ আইন ও স্বাধীনতার পরস্পর বিরোধী সম্পর্কে বিশ্বাসী। তারা মনে করেন যে, সমাজে আইনের কর্তৃত্ব যত বেশি সেখানে স্বাধীনতা ততই কম। আইন কোন না কোনভাবে জনগণের স্বাধীনতা খর্ব করে।
এ মতের সমর্থক ডাইসী (Diccy) বলেন, “আইন বাড়লে স্বাধীনতা কমে এবং স্বাধীনতা বাড়লে আইন কমে।”
হার্বার্ট স্পেন্সার (H. Spencer) বলেন, “আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী।”
উইলিয়াম গডউইন (William Godwin) বলেন যে, “আইন ক্ষতিকর প্রবণতামূলক প্রতিষ্ঠান।”
খ. দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ: এরিস্টটল (Aristotle), মন্টেছু (Montesquieu), জন লক (John Locke), রুশো (Rousseau), রীখি (Ritchie), উইলোবী (Willoughby), বার্কার (Barker), লাস্কি (Laski) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করেন আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাঁদের মতে, আইনের মাধ্যমেই কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের কল্যাণ সাধন করা সম্ভব।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লক (Locke) বলেন, “Where there is no law there is no freedom.” অর্থাৎ, যেখানে আইন নেই সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।
আইন ও স্বাধীনতার প্রকৃত সম্পর্ক নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. আইন স্বাধীনতার বিরোধী নয়: ডাইসি, মিল, স্পেন্সার প্রমুখ দার্শনিক আইন ও স্বাধীনতার পরস্পর বিরোধিতার কথা বলেছেন। তাঁদের মতানুসারে, ব্যক্তিগত কার্যকলাপের উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা আইনের অধিক নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তাঁদের আইন ও স্বাধীনতা সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। আইন ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী নয়, পরস্পরের সম্পূরক।
২. স্বাধীনতা আইনের উপর নির্ভরশীল: রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত অধিকারের ভিত্তিতেই স্বাধীনতার সৃষ্টি হয়। আইনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র এ অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণ করে। সুতরাং স্বাধীনতা আইনের উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও আইনের উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ করা।
৩. অহিন স্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ: মুষ্টিমেয় ধূর্ত ও শক্তিশালী ব্যতিনা দ্বারা দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তির স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। আইনের নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়। আইন মানুষের আচার আচরণের সীমা নির্ধারণ করে। ফলে স্বাধীনতা সংরক্ষিত হতে পারে। এ অর্থে আইন স্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লক (John Locke) বলেন, স্বাধীনতার বিলুপ্তি অথবা সংযুক্ত করা আইনের উদ্দেশ্য নয়, বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীনতা সংরক্ষিত ও প্রসারিত করা।
৪. আইনানুমোদিত স্বাধীনতা: রাষ্ট্র আইন দ্বারা সকলের স্বাধীনতা রক্ষা করে। আইনের দ্বারা সৃষ্ট ও সংরক্ষিত স্বাধীনতা আইনানুমোদিত স্বাধীনতা হিসেবে গণ্য হয়। আর আইনানুমোদিত স্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিত বা অবাধ হতে পারে না।
বার্কার এর মতানুসারে, “আইনসঙ্গত স্বাধীনতা আইনানুমোদিত বলেই অবাধ বা নিঃশর্ত হতে পারে না।”
৫. ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থি নয়: আইনানুমোদিত স্বাধীনতা নির্দিষ্ট। ব্যক্তির আত্মশক্তি বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতাটুকু ব্যক্তিকে দেয়া হয়। এ স্বাধীনতা অপর কারও ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থি হতে পারে না।
৬. স্বাধীনতা অবাধ নয়: বার্কার যথার্থই বলেছেন, “প্রত্যেক ব্যক্তিনাই স্বাধীন হওয়া উচিত। তবে কোন ব্যক্তিই অবাধভাবে স্বাধীন হতে পারে না।” এজন্য স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে পারে না। স্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিত হলে দুর্বলের স্বাধীনতা সবলের দয়ার দানে পরিণত হয়। সুতরাং নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা সকলের জন্য প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব কাজকর্ম, চলাফেরা, অধিকার রক্ষা তা অবশ্যই আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যাবে না। যদিও এমন কতকগুলো আইন রয়েছে, যা স্বাধীনতার পক্ষে ভীতিস্বরূপ বা স্বাধীনতাকে খর্ব করে, তথাপি জনমতের দ্বারা সৃষ্ট আইন যদি সুস্পষ্টভাবে প্রয়োগ করা হয় তবে তা স্বাধীনতাকে খর্ব করে না, বরং স্বাধীনতাকে রক্ষা করে। তাই বলা হয়ে থাকে যে, “আইন স্বাধীনতার পূর্বশর্ত, স্বাধীনতার সহায়ক ও পরিপূরক।”