স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা কর।

অথবা, স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা কর।

অথবা, স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পরবিরোধী এবং স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর সম্পূরক ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা এ তিনটি রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গঠনের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এ তিনটি আদর্শের মধ্যে স্বাধীনতার গুরুত্ব অনেকেই সর্বাধিক বলে মনে করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য সাম্য প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। কেননা স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক: সাম্য ও স্বাধীনতা একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির অস্তিত্বের কথা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু এক সময় সাম্য ও স্বাধীনতাকে পরস্পরবিরোধী আদর্শ বলে মনে করা হতো। সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে দু’টি পরস্পরবিরোধী মতবাদ প্রচলিত আছে। যথা:

১. প্রথম মতবাদ: লর্ড অ্যাকটন (Lord Acton), ডি, টক্সিল (De Tocqueiville), হার্বার্ট স্পেন্সার (Herbert Spencer), বেয়াহট (Begehot), লেকি (Lecky) প্রমুখ চিন্তাবিদ মনে করেন স্বাধীনতা মানুষকে নিজের ইচ্ছামতো সবকিছু করার ক্ষমতা দেয় কিন্তু সাম্য কাউকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা প্রদানের পক্ষপাতী নয়।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড অ্যাকটন (Lord Acton) ও ডি. সিভিল (De Tocqueivelle) এর মতে, “সাম্য ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।”

লর্ড অ্যাকটন (Lord Acton) বলেছেন, “The passion for equality makes vain the hope of freedom.” অর্থাৎ সাম্যের জন্য আবেগ স্বাধীনতার আকাশে নির্মূল করে।

এ দলের মতবাদ অর্থনৈতিক সাম্যের দিকেই ইঙ্গিত করেছে। তাঁদের মতে, সাম্যনীতি অনুসরণ করতে হলে বিত্তশালী বা সম্পদশালীর বিত্ত ‘বা সম্পদের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া উচিত। কেননা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নিয়ন্ত্রণহীন অবাধ স্বাধীনতার কোন স্থান নেই।

২. দ্বিতীয় মতবাদ: রুশো (Rousseau), মেইটল্যান্ড (Maitland), লাক্সি (Laski), বার্কার (Barker), কোল (Cole), টিনি (Tawney) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরবিরোধী নয়, বরং সম্পূরক। সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না। কেননা মানুষে মানুষে ব্যবধান সৃষ্টি হলে সবল দুর্বলের উপর হস্তক্ষেপ করে।

আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ রুশো (Rousseau) বলেন, “সাম্য ছাড়া স্বাধীনতা থাকতে পারে না।” (Liberty cannot exist without equality.)
নীতির পাশাপাশি সাম্যের অবস্থান। এ দু’য়ের সাথে বিশেষত স্বাধীনতার সাথে সাম্যের সামঞ্জস্য বিধান আবশ্যক।” বার্কার (Barker) এর মতে, “স্বাধীনতা ও সাম্য কোন বিচ্ছিন্ন নীতি বা আদর্শ নয়। স্বাধীনতা ও সৌভ্রাতৃত্বের

নিম্নে সাম্য ও স্বাধীনতার প্রকৃত সম্পর্ক দেয়া হলো:

১. সাম্য প্রকৃত স্বাধীনতার ভিত্তি: সাম্যের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে স্বাধীনতার উপলব্ধি অসম্ভব। রুশো বলেছেন, “Liberty cannot exist without equality.” স্বাধীনতার আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য সাম্যের পরিবেশ প্রয়োজন। সমাজে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা থাকলে স্বাধীনতা মূলাহীন হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চোরাবালির উপর স্বাধীনতার সৌধ নির্মাণ করা যায় না। সাম্য ও সমানাধিকারের ভিত্তিতেই প্রকৃত স্বাধীনতা উপলব্ধি করা যায়।

২. সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক: সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণা অভিন্ন বললে বেশি বলা হয় না। অধ্যাপক লাঙ্কির মতানুসারে, স্বাধীনতা বলতে এক বিশেষ পরিবেশকে বুঝায়, যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ সাধন করতে পারে। সাম্য বলতেও প্রকৃতপক্ষে একটি পরিবেশকে বুঝায়, যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ পায়। সুতরাং সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক, পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মানবতার নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ যদি স্বাধীনতা হয় তাহলে সাম্যভিত্তিক সমাজ ছাড়া এ স্বাধীনতা অসম্ভব।

৩. অর্থনৈতিক সাম্য স্বাধীনতার পূর্বশর্ত: সম্পদ কটনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য স্বাধীনতার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের সাহায্য করে। ধনসম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত যারা সমাজে তাদের অবহেলিত অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। বস্তুত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার অস্তিত্ব অসম্ভব। লাস্কি বলেছেন, “। am urging that great inequalities of wealth make impossible the attainment of freedom.”

৪. অধিকারের সংরক্ষক: সাম্য ও স্বাধীনতা উভয়ই অধিকারের সংরক্ষক। স্বাধীনতা হচ্ছে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের একটি পূর্বশর্ত। আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান। সমানাধিকারের মাধ্যমে নাগরিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্য, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ ও প্রতিপত্তির ভেদাভেদ ভুলে সমান অধিকার ভোগের সুযোগ সৃষ্টি করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে শুধু শব্দগত ছাড়া অর্থগত দিক থেকে তেমন কোন পার্থক্য নেই। উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক বিরাজমান। স্বাধীনতাবিহীন সাম্য যেমন অসম্পূর্ণ, তেমনি সাম্যবিহীন স্বাধীনতাও অপূর্ণাঙ্গ। স্বাধীনতাবিহীন সাম্য দাসত্বের এবং সাম্যবিহীন স্বাধীনতা উচ্ছৃঙ্খলতার পথ প্রশস্ত করে। সুতরাং সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক।