অথবা, আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকারের মধ্যে বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর।
অথবা, আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকারের বৈপরীত্য দেখাও।
উত্তরঃ ভূমিকা: জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করে সুখী হওয়ার জন্যই মানুষ রাষ্ট্রের মধ্যে সংগঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। মানুষ আশা করে যে, তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সুখসমৃদ্ধি সাধনে রাষ্ট্র উপযুক্ত অবস্থার সৃষ্টি করবে। বঙ্গত মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হলো আদায়ের প্রকৃতি ও চরিত্রের উপর তিও সুধী সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করবে। এর অর্থ হলো রাষ্ট্র ব্যক্তির জন্য অধিকার সুন্নির মাধ্যমে ব্যক্তির বাক্তিত্ব বিকাশের ‘সহায়ক জীবনাগড়ে তোলা। অধিকার সবসময় এক রকম হয় না তা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। প্রকৃতি ও চরিত্রের উপর ভিত্তি করে অধিকারকে প্রধানত দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়। অর্থাৎ আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকার।
ক. আইনগত অধিকার: আইনগত অধিকার হচ্ছে সাধারণ অধিকারের একটি বিশেষ রূপ। রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের যারা স্বীকৃত ও সংরক্ষিত দাবিদাওয়াকে আইনগত অধিকার বলে। আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকার হলো রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সরক্ষিত দাবি। T. H. Green এর মতে, “মানুষ কেবল রাষ্ট্রীয় সমাজের সভ্য হিসেবেই অধিকার লাভ করতে পারে। কারণ রাষ্ট্রীয় সমাজের মধ্যেই দাবিদাওয়ার স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।” অধিকার মূলত একটি সামাজিক ধারণা। রাষ্ট্র সমাজের পক্ষে আইনের মাধ্যমে অধিকারকে স্বীকৃতি জানায় এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে।
খ. নৈতিক অধিকার: নৈতিক অধিকার বলতে বুঝায়, মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ও ব্যক্তিজীবনের যথাযথ প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা। আদর্শবাদী বা নৈতিক ধারণা অনুসারে মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলি বা ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের উপযোগী বাহ্যিক পরিবেশই হলো নৈতিক অধিকার। বস্তুত যে অধিকার মানুষের বিবেক ও ন্যায়বোধ থেকে উৎসারিত হয় তাই নৈতিক অধিকার হিসেবে খ্যাত।
আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকারের মধ্যে পার্থক্যঃ কোন ব্যক্তি বা সমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন ও মঙ্গল সাধনের জন্য প্রয়োজন অধিকারের। রাষ্ট্র এসব অধিকারকে স্বীকার করে নিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। আর রাষ্ট্রের চরিত্র ও প্রকৃতি মানব অধিকারের স্বীকৃতির মাধ্যমে বুঝা যায়।
বস্তুতপক্ষে আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকার উভয়েরই মূল উদ্দেশ্য ব্যক্তি ও সমষ্টির কল্যাণ সাধন করা হলেও এ দু’য়ের মধ্যে বেশকিছু পার্থক্য রয়েছে। নিম্নে আইনগত অধিকার ও নৈতিক অধিকারের মধ্যে পার্থক্যসমূহ যথাযথ পরিসরে আলোচনা করা হলো:
১. উৎসগত পার্থক্য: আইনগত অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রয়োগযোগ্য। এ অধিকারের মূল উৎস হচ্ছে রাষ্ট্রের আইন বা রাষ্ট্র। এ ধরনের অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করে থাকে। পক্ষান্তরে, নৈতিক অধিকার সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ ও রীতিনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ অধিকারের মূল উৎস হলো সমাজের নৈতিকতাবোধ বা বিবেকবোধ। সামাজিক মানুষের কল্যাণ তথা সমাজের ব্যক্তি ও সমষ্টির কল্যাণের জন্য সমাজে এ ধরনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়।
২. শাস্তির বিধানগত পার্থক্য: আইনগত অধিকার যেহেতু রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রযুক্ত সেহেতু এ ধরনের অধিকারে কাউকে বাধা প্রদান করলে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান করা হয়। অপরদিকে, নৈতিক অধিকারে হস্তক্ষেপের জন্য কোনরূপ সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান নেই। এর জন্য সমাজ কর্তৃক নিন্দিত হতে হয় এবং বিবেকের তাড়নায় দগ্ধ হতে হয়। অর্থাৎ আইনগত অধিকার লঙ্ঘন করলে যেমন শাস্তি পেতে হয়, নৈতিক অধিকারে এরূপ শাস্তির বিধান নেই।
৩. সুনির্দিষ্ট পার্থক্য: আইনগত অধিকারগুলো রাষ্ট্রীয় আইনে লিপিবদ্ধ থাকে বলে এগুলো সুনির্দিষ্ট ও সুবিধিত। অপরদিকে, নৈতিক অধিকার, কোথাও বিধিবদ্ধ নয় বলে এগুলো সুনির্দিষ্ট নয়। এ ধরনের অধিকার ব্যক্তি, সমাজ ও সময় বিশেষে কমবেশি মাত্রায় হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, নৈতিক অধিকারসমূহের সুনির্দিষ্ট কোন ভিত্তি নেই।
৪. বিষয়বস্তুগত পার্থক্য: আইনগত অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত। ব্যক্তি ও সমষ্টির সার্থক ও সুন্দর জীবনের জন্য এগুলো অত্যাবশ্যক। যেমন- জীবনধারণের অধিকার, সম্পত্তি ভোগের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, সমালোচনা করার অধিকার, ভোটদানের অধিকার, চাকরি লাভের অধিকার ইত্যাদি আইনগত অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে, দুর্গতদের প্রতি সহানুভূতি, প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য, গুরুজনদের প্রতি ভক্তি, শিষ্টাচার, সদাচার ইত্যাদি নৈতিক অধিকার বলে স্বীকৃত।
৫. সুস্পষ্টতার পার্থক্য: আইনগত অধিকার রাষ্ট্রের আইন দ্বারা সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। এগুলো মোটামুটি সবার কাছেই একইরূপে স্বীকৃত। অন্যদিকে, নীতিবোধ বা নৈতিকতার মাত্রা সবার সমান হয় না বলে নৈতিক অধিকার তত স্পষ্ট নয়।
৬. শ্রেণি বিভাজনে পার্থক্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ আইনগত অধিকারকে বিভিন্নভাবে ভাগ করে থাকেন এবং বিভিন্নভাবে এই ভাগ করা যায় বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। অন্যদিকে, নৈতিক অধিকারকে সাধারণত কোন প্রকরণ বা বিভক্ত করা হয় না। ও এ অধিকার সবসময়ই নৈতিক অধিকার হিসেবেই সমাজে স্বীকৃত।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র তথা সমাজকল্যাণের জন্য নৈতিক ও আইনগত উভয় অধিকারই প্রয়োজন হয়। তবে রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো আইনগত অধিকারগুলোকে যথাযথভাবে রক্ষা করা তথা সুনিশ্চিত করা এবং একদিকে নৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতিদান এবং অন্যদিকে সমাজকল্যাণ ও রাষ্ট্রতত্ত্বের পরিপন্থি অধিকারগুলো বিলোপ সাবন করা। বর্তমানে আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণানুযায়ী তা করাই বিধেয়। Prof. Laski যথার্থই বলেছেন, “Every state is known by the rights it maintains.”