আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, কর্তব্য বলতে কী বুঝ? নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ বর্ণনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করে সুখী হওয়ার জন্যই মানুষ রাষ্ট্রের মধ্যে সংগঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের আনুগত্য প্রদর্শন করে। মানুষ আশা করে যে, তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সুখসমৃদ্ধি সাধনে রাষ্ট্র উপযুক্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করবে। বস্তুত মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হলো অধিকার ভোগের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর ও সুখী জীবন গড়ে তোলা। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে যেমন প্রত্যেক নাগরিক কিছু অধিকার ভোগ করে, তেমনি নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের অবশ্যই করণীয় কিছু কাজ আছে। রাষ্ট্র এসব কর্তব্যগুলো প্রত্যেক নাগরিকের নিকট প্রত্যাশা করে।

কর্তব্য: কর্তব্য বলতে বুঝায় রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে নাগরিকগণ রাষ্ট্রের প্রতি যে দায়িত্ব পালন করেন।

প্রামাণ্য সংজ্ঞা: কর্তব্য সম্পর্কে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিন্ন ভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো:

এ. সি. কাপুর (A. C. Kapur) বলেছেন, “আইনের দ্বারা স্বীকৃত অধিকার ভোগের বিনিময় নাগরিক যেসব দায়িত্ব পালন করে তাই কর্তব্য।”

অধ্যাপক লাঙ্কি (Prof. Laski) বলেছেন, “কর্তব্য বলতে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য কোনকিছু করা বা না করার দায়িত্বকে বুঝায়।”

আর. সি. আগরওয়াল (R. C. Agarwal) এর ভাষায়, “A duty is an obligation to a member of a society of state to observe this obligation of society.”

উইলিয়াম এ. ফ্রাঙ্কেনা (William A. Frankena) এর মতে, “কর্তব্য হচ্ছে এমন এক নীতিনিষ্ঠ আচরণ যা সকল সময়ই মানুষ পালন করতে বাধ্য থাকে।”

উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়, কর্তব্য হচ্ছে অধিকার ভোগের বিনিময়ে নাগরিক কর্তৃক রাষ্ট্রের প্রতি কতিপয় দায়িত্ববোধ।

নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ: কর্তব্য পালনের মাধ্যমে নাগরিকের দায়িত্বের প্রকাশ ঘটে। আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকগণ রাষ্ট্রের প্রতি কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য পালন করছে। যা নিম্নে তুলে ধরা হলো:

১. আনুগত্য প্রদর্শন: রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন নাগরিকের সর্বপ্রথম কর্তব্য। প্রত্যেক নাগরিকের উচিত রাষ্ট্রের
প্রতি নিজেকে সমর্থন করা। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অর্থ হচ্ছে নাগরিকের রাষ্ট্রীয় মৌলিক আদর্শের প্রতি অনুগত থাকা। যেমন- বাংলাদেশের চারটি মূলনীতির প্রতি সকল নাগরিকের অনুগত থাকা উচিত।

২. আইন মেনে চলা: রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলা নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য। রাষ্ট্রের সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রের নাগরিকগণ আইন মেনে চলতে বাধ্য। Austin এর ভাষায় বলা যায়, “রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের আদেশই আইন।” (Law is the command of the state.) এগুলো নাগরিকগণ মেনে চলতে বাধ্য। তবে নাগরিক নৈতিকতা বিরোধী আইন উপেক্ষা করতে পারবে।

৩. কর প্রদান: নিয়মিত কর প্রদান করা নাগরিকের অন্যতম মৌলিক কর্তব্য। এটি নাগরিকের একটি অর্থনৈতিক অধিকারও বটে। এটি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন পড়ে। সরকার বিভিন্ন উপায়ে এ অর্থ সংগ্রহ করে। কর হচ্ছে সরকারি রাজস্ব আদায়ের অন্যতম উৎস।

৪. ভোট প্রদান করা: সততার সাথে ভোট প্রদান করা নাগরিকের একটি মৌলিক কর্তব্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক নাগরিকের উচিত উক্ত নির্বাচনে সততার সাথে একটা ভোট প্রদান করা। যোগ্য প্রার্থীকে নাগরিকগণ তার পবিত্র ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত করবেন।

৫. সংবিধান মান্য করা: প্রত্যেক নাগরিকের উচিত রাষ্ট্রের সংবিধানকে মান্য করা। সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার দলিলস্বরূপ। সংবিধানের মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় বিধিবিধান অন্তর্ভুক্ত থাকে। ‘Encyclopedia of Social Science’ বলা হয়েছে, “The duty of a citizen is to abide by the constitution.”

৬. শিক্ষা প্রদান করা: সন্তানকে শিক্ষা প্রদান করা প্রত্যেক নাগরিকের একান্ত কর্তব্য। তবে সন্তানকে শিক্ষা প্রদানের পূর্বে নিজেকে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা মনুষ্যত্ব বিকাশের সকল গুণাবলির বিকাশ ঘটায়। পিতামাতা তার সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে। সুশিক্ষিত নাগরিক গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি পূর্বশর্ত।

৭. রাষ্ট্রের সেবা করা: আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিকের উচিত রাষ্ট্রের সেবা প্রদান করা। রাষ্ট্রের সেবা করার অর্থ হলো রাষ্ট্রীয় চাকরি গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করা। প্রত্যেকের স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে গতিশীলতা আসে।

৮. সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা: সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের একটা মৌলিক ও অপরিহার্য উপাদান। সার্বভৌমত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা নাগরিকের অন্যতম পবিত্র দায়িত্ব। এটা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ও চরম ক্ষমতা বিধায় এটাকে রক্ষা করা সকল নাগরিকের কর্তব্য।

উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায় যে, নাগরিকগণ রাষ্ট্রের নিকট থেকে বহু অধিকার লাভকরে। অপরদিকে, তাদেরকে রাষ্ট্রের প্রতি বহু কর্তব্য পালন করতে হয়। বস্তুত অধিকার ও কর্তব্য সুখদুঃখের ন্যায় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর নির্ভরশীল এবং একে অন্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। প্রকৃতপক্ষে, আধুনিক রাষ্ট্রে একজনের অধিকার বললে অন্য জনের কর্তব্য বুঝা যাবে। “অধিকারের মধ্যে কর্তব্য নিহিত” রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত উক্তি। আধুনিক রাষ্ট্রে তাই নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য রাষ্ট্র কর্তৃক সুনির্ধারিত ও সংরক্ষিত হয়ে থাকে।