অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় কর।

অথবা, “অধিকার ও কর্তব্য-একে অপরের উপর নির্ভরশীল।”-আলোচনা কর।

অথবা, “অধিকার ও কর্তব্য একই সাথে চলে” আলোচনা কর।

অথবা, কর্তব্য অধিকারের পূর্বশর্ত বক্তব্যটি বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: জীবনকে সুন্দরভাবে গঠন করে সুখী হওয়ার জন্যই মানুষ রাষ্ট্রের মধ্যে সংগঠিত হয় এবং রাষ্ট্রের আনুগত্য প্রদর্শন করে। মানুষ আশা করে যে, তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সুখসমৃদ্ধি সাধনে রাষ্ট্র উপযুক্ত সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করবে। বস্তুত মানুষের রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হলো অধিকার ভোগের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর ও সুখী জীবন গড়ে তোলা। Prof. Laski বলেছেন, “রাষ্ট্র অধিকার প্রদানের মাধ্যমে মানুষের আত্মবিকাশে করার বা না করার দায়িত্বকে বুঝায়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নাগরিকের অধিকারের মত কর্তব্যের উপরও বিশেষ গুরুত্বারোপ হয়।

অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক: কর্তব্য বলতে কোনকিছু করার বা না করার দায়িত্বকে বুঝায়। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে নাগরিকের অধিকারের মত কর্তব্যের উপরও বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। নাগরিকগণ রাষ্ট্রের কাছ থেকে যেমন কিছু অধিকার ভোগ করে, তেমনি তাদের কিছু কর্তব্যও আছে। বস্তুত কর্তব্য ছায় অধিকার পরিপূর্ণ হয় না। নিম্নে অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যথাযথ পরিসরে তুলে ধরা হলো:

১. অধিকারের মধ্যেই কর্তব্যের ধারণা বর্তমান: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি বহুল প্রচলিত উক্তি হলো “Right imply duties.” বস্তুত অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত আছে এবং অধিকার ও কর্তব্য পরস্পরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। সমাজবদ্ধ মানুষ একে অপরের উপর কতকগুলো দাবি করে। এ দাবি বা প্রত্যাশাগুলো স্বীকৃত হলে অধিকারের সৃষ্টি হয়। আর এগুলো স্বীকার করার অর্থ হলো কতকগুলো দায়িত্ব বা কর্তব্য পালনের অঙ্গীকার দেয়া। মূলত পারস্পরিক এ দাবিসমূহের একদিক হলো অধিকার এবং অপরদিক হলো কর্তব্য। নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অধিকার অপরিহার্য। সুতরাং কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে অধিকারের গুরুত্ব কম নয়।

২. অধিকারের পরিধি কর্তব‍্য দ্বারা সীমাবদ্ধ : অধিকার অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। সীমাহীন অধিকার স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। অধিকার যদি অবাধ হয় তাহলে কেবল সকলের পক্ষেই অধিকার ভোগ করা সম্ভব হবে, দুর্বলের অধিকার থাকবে না। প্রকৃতপক্ষে, সমাজে একজনের অধিকারের পরিধি, অন্যান্য সকলের প্রতি তার কর্তব্যবোধ বা কর্তব্যের দ্বারা সীমিত ও গণ্ডিবদ্ধ। অর্থাৎ অধিকার পেতে হলে কর্তব্য অবশ্য পালনীয়।

৩. রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালনের উপর নাগরিকের অধিকার নির্ভরশীল: রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত দাবিদাওয়াকে অধিকার বলে। Barker এর মতানুসারে, “রাষ্ট্রই হলো সকল অধিকারের উৎস।” অর্থাৎ রাষ্ট্রই মানুষের অধিকার সৃষ্টি করে এবং সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে, এ হলো রাষ্ট্রের কর্তব্য। ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকেরও কর্তব্য আছে। এসব কর্তব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আনুগত্য প্রদর্শন, নিয়মিত কর প্রদান, রাষ্ট্রীয় আইন মেনে চলা প্রভৃতি। বস্তুত রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন না করে নাগরিকগণ তাদের অধিকার আশা করতে পারে না। তেমনি আবার রাষ্ট্রও তার কর্তব্য পালন না করে নাগরিকদের কাছে কোন কর্তব্য দাবি করতে পারে না। অর্থাৎ কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই কেবল অধিকার ভোগ করা সম্ভব।

৪. নৈতিক অধিকার ও নৈতিক কর্তব্য সম্পর্কযুক্ত: নৈতিক অধিকার এবং নৈতিক কর্তব্যের মধ্যেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। বার্ধক্যে অক্ষম মাতাপিতা সন্তানের কাছে ভরণপোষণের নৈতিক অধিকার দাবি করেন। সন্তানের কর্তব্য হলো বৃদ্ধ মাতাপিতার সেবাযত্ন করা। তেমনি সন্তানের শৈশব অবস্থায় লালনপালন, শিক্ষা, চরিত্র গঠন প্রভৃতির যথাযথ ব্যবস্থা করা মাতাপিতার কর্তব্য। সন্তানের কাছ থেকে মাতাপিতার অধিকার ভোগ, সন্তানের প্রতি তাঁদের কর্তব্য পালনের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। অতএব নৈতিক দিক থেকে অধিকার ও কর্তব্য পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।

৫. কর্তব্য পালনের উপর অধিকার নির্ভরশীল: অধিকার ভোগ করতে হলে কর্তব্য পালন করতে হয়। কর্তব্য পালন না করে অধিকার ভোগ করা যায় না। Prof. Laski এর মতে, “যে কর্তব্য পালন করবে না সে অধিকারও ভোগ করতে পারবে না।” বস্তুত একজনের অধিকার ভোগ অপর সকলের কর্তব্য পালনের উপর নির্ভরশীল।

৬. কর্তব্য পালনের মাধ্যমে অধিকার অর্জন করতে হয়: ব্যক্তিসত্তা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অধিকার অর্জন করতে হয়। কর্তব্য পালনের মাধ্যমে তা অর্জন করা যায়। আমি আমার কর্তব্য যত্নসহকারে পালন করে অপরের অধিকার ভোগকে নিশ্চিত করতে পারলে, অপরের কর্তব্য সম্পাদনের ভিত্তিতে আমার অধিকার অর্জিত হয়। আমি যদি অপরের কাছ থেকে জীবনের অধিকার দাবি করি, তবে আমার উচিত অপরের জীবন নাশ না করা। এভাবে কর্তব্য পালনের মাধ্যমে অধিকার অর্জন করতে হয়।

৭. কর্তব্য সম্পাদনের জন্য অধিকার প্রয়োজন: সুষ্ঠুভাবে কর্তব্য সম্পাদনের জন্য অধিকার প্রয়োজন। নিজ পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের বহু ও বিভিন্ন কর্তব্য আছে। এ সমস্ত কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করার জন্য গুণগত যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন। মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন অধিকারের। অর্থাৎ অধিকার ভোগের ভিত্তিতেই কর্তব্য পালনের যোগ্যতা জন্মায়। যে ব্যক্তি পরিবারের প্রতি যত বেশি তার কর্তব্য পালন করে সে ব্যক্তি পরিবার থেকে তত বেশি অধিকার ভোগ করে থাকে।

৮. একজনের অধিকার অন্যের কর্তব্য: Modern political scientist’রা মনে করেন, যে কোন বিষয় একজনের যা অধিকার তা অন্যের কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। Prof. Hobhouse বলেছেন, “If I have the right to walk along the street without being pushed off the payment, it is your duty to give me reasonable room.”

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ব্যক্তি বা সমষ্টির ব্যক্তিত্ব ও জীবন পূর্ণ বিকশিত করার জন্য সমাজ তাদেরকে যে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করে তার সমষ্টিই হলো অধিকার। অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয় এবং এগুলোর লক্ষ্য সর্বজনীন কল্যাণ সাধন। কিন্তু ব্যক্তি বা সমষ্টির অধিকার সুনিশ্চিত হয় কর্তব্য বা দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। অধিকার ও কর্তব্য নানাভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বস্তুত অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত আছে। কর্তব্য ছাড়া অধিকার ভোগ করা চলে না।