অথবা, জাতীয়তাবাদের উপাদানগুলো আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: আধুনিক বিশ্বে জাতি ও জাতীয়তা শব্দ দু’টি বিশেষভাবে পরিচিত। সাধারণত জাতি ও জাতীয়তা শব্দ দু’টি একই অর্থে ব্যবহহৃত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জাতি ও জাতীয়তা শব্দ দু’টি এক বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জাতি ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে। জাতীয়তার উপাদানগুলো নিয়েই জাতি গঠিত হয়। আবার দেখা গেছে পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্র জাতীয়তার ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে।
জাতি: ইংরেজি ‘Nation’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘জাতি’। ‘Nation’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Natus’ বা Natio’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ জন্ম। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে জাতি বলতে বুঝায় একই বংশোদ্ভূত জনসমষ্টি। জাতীয়তাবাদ: সাধারণত কোন জনসমষ্টির নিজের ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় জীবন গড়ে তোলার মানসিক অনুভূতি ও অনুরাগকেই জাতীয়তা বা জাতীয়তাবাদ বলে।
জাতি গঠনের বা জাতীয়তাবাদের উপাদান: জাতি গঠনের একাধিক উপাদান বিদ্যমান। নিম্নে জাতি গঠনের বা জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত উপাদানগুলো উপস্থাপন করা হলো:
১. ভাষাগত ঐক্য: ভাষা ও সাহিত্য মনের ভাব আদানপ্রদানের অন্যতম মাধ্যম। একই ভাষাভাষী লোকদের মধ্যে অতি সহজেই একাত্মবোধ গড়ে উঠে এবং তাদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি হয়। তবে জাতীয়তাবোধ ভাষা ও সাহিত্যগত ঐক্য ছাড়াও গড়ে উঠতে পারে। যেমন- সুইজারল্যান্ডে তিনটি ভাষা প্রচলিত থাকলেও এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের লোকেরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বললেও সুইজারল্যান্ড ও ভারতের লোকেরা আপন আপন জাতীয়তাবোধে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ। অন্যদিকে, ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের ভাষা এক হলেও তারা দু’টি আলাদা জাতি হিসেবে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে Prof. H. J. Laski বলেছেন, “Common language helps a lot in united people, people sharing the common language, also share common cultured and literature.”
২. বংশগত ঐক্য: বংশগত ঐক্য জাতীয়তাবোধ বা জাতি গঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বংশগত ঐক্য বজায় থাকলে সহজেই জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠে। একই বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ প্রবল। এ বংশের লোকদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক থাকে এবং তারা যে কোন ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। ফলে জাতীয়তাবোধ প্রবল হয়। বর্তমান বিশ্বে বংশগত ঐক্যের কারণে অনেক বহুজাতিক রাষ্ট্র সৃষ্টি হচ্ছে।
৩. একই শাসনব্যবস্থা: দীর্ঘদিন ধরে একই শাসনব্যবস্থার অধীনে বাস করার ফলে জনগণের মধ্যে জাতি গঠনের স্পৃহা সৃষ্টি হয় এবং জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন বংশের ও ভাষার লোক বহুদিন ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে বাস করার ফলে তাদের পৃথক সত্তা লোপ পেয়েছে এবং তারা জাতিতে পরিণত হয়েছে।
৪. ধর্মীয় ঐক্য: ধর্মীয় ঐক্যের ফলে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। ঈশ্বরের একই প্রকার আরাধনা জনগণকে সমধর্ম বিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ করে। এর ফলে জনগণের মধ্যে গভীর জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয়। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট (Gilchrist) এর মতানুসারে, “ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে পার্থক্য প্রবল হলে জাতিগত ঐক্য ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য।” এ প্রসঙ্গে G. Liyod বলেছেন, “The possession of common religion has been extremely important in creation nation state.”
৫. অর্থনৈতিক ঐক্য: অর্থনৈতিক ঐক্য জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের চেতনাকে জাগ্রত করে। জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বৈষয়িক স্বার্থ যদি অভিন্ন হয়, তবে তাদের মধ্যে সহজেই ঐক্যবোধ গড়ে উঠে। তখন তারা একই জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত হয়।
৬. রাষ্ট্রীয় ঐক্য: রাষ্ট্রীয় ঐক্য জাতি গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাষ্ট্র ছাড়া জাতির বিকাশ ঘটতে পারে না। একমাত্র জাতীয় রাষ্ট্র সংগঠনই এক জাতি থেকে অপর জাতিকে পৃথক করে রাখে। তাই জাতি গঠনের জন্য তথা জাতীয়তার বিকাশ ও সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় ঐক্য একান্ত প্রয়োজন।
৭. ভাবগত ঐক্য: আধুনিক রাষ্ট্রের ঐক্যবোধের ভিত্তি বাহ্যিক নয়, মানসিক। বংশগত, ভাষাগত, ধর্মগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ভাবগত ঐক্যের ভিত্তিতেই জনসমাজের মধ্যে জাতীয়তাবোধ গভীরভাবে জাগরিত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে Cocker বলেছেন, “Nationality is primarily the product of historical experience and cultural tradition.”
৮. ভৌগোলিক ঐক্য: ভৌগোলিক ঐক্য জাতি গঠনের জন্য সাহায্যকারী উপাদানের মধ্যে অন্যতম। কেননা একই
ভৌগোলিক সীমারেখায় বসবাসকারী জনগণের মধ্যে একটা প্রগাঢ় ঐক্যের বন্ধন গড়ে উঠে। এ বন্ধনই জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এ প্রসঙ্গে Dr. Garner বলেছেন, “Common residence, common territory or geographical unity is a basic factor which helps to promote the national feelings or the feelings of nationality.”
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জাতি গঠনের ক্ষেত্রে উক্ত বৈশিষ্ট্যাবলি বিদ্যমান। এছাড়া জাতীয়তাবাদ মূলত একটি অনুভূতি। উল্লিখিত উপাদানগুলোর অবর্তমানেও জনগণের মানসিক অনুভূতিই তাদেরকে জাতীয়তাবাদের মোহমন্ত্রে দীক্ষিত করতে পারে। এজন্য অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, “জাতীয়তাবাদের ধারণা এক প্রকার মানসিক ধারণা। তবে একথাও সত্য যে, জাতীয়তাবাদের অন্যান্য উপদানগুলো কমবেশি যাহোক না কেন এ মানসিক ঐক্যবোধ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।”