জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা কর।

অথবা, জাতি ও জাতীয়তাবাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর।

অথবা, জাতি ও জাতীয়তাবাদের বৈপরীত্য দেখাও।

উত্তরঃ ভূমিকা: জাতি হলো এমন এক জনসমাজ যা ক্রমবিকাশের সাথে সাথে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অর্থাৎ জাতি জনসমাজেরই চূড়ান্ত রূপ। আর এ জাতি যখন নিজেদের ইচ্ছামতো কোন জীবন প্রণালী তৈরি করে বা কোন বিশেষ অনুভূতিতে অনুপ্রাণিত হয়, তখন তাকে বলে জাতীয়তা বা জাতীয়তাবাদ। জাতি এবং জাতীয়তাবাদ শব্দ দু’টি বর্তমান বিশ্বে বহুভাবে আলোচিত হয়। কিন্তু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয়তাবাদকে সভ্যতার সংকট হিসেবে অভিহিত করেছেন।

জাতি: ইংরেজি ‘Nation’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘জাতি’। ‘Nation’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Natus’ বা Natio’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ জন্ম। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে জাতি বলতে বুঝায় একই বংশোদ্ভূত জনসমষ্টি।

জাতীয়তাবাদ: সাধারণত কোন জনসমষ্টির নিজের ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় জীবন গড়ে তোলার মানসিক অনুভূতি ও অনুরাগকেই জাতীয়তা বা জাতীয়তাবাদ বলে।

আতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য: জাতি ও জাতীয়তার উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। কেননা একই শব্দ থেকে জাতি ও জাতীয়তা শব্দ দু’টি উৎপত্তি লাভ করেছে। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে বলেছেন, “জাতীয়তা হলো সে জনসমষ্টি যারা এক ভাষা ও সাহিত্য, বংশ ও ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, আশা ও আকাঙ্ক্ষা এবং ভৌগোলিক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ ও লালিত। কিন্তু জাতি হলো সে জাতীয় সমাজ বা জাতীয়তা যা রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং স্বাধীন অথবা স্বাধীনতা লাভে আগ্রহী।” নিম্নে জাতি ও জাতীয়তা বা জাতীয়তাবাদের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হলো:

১. সংজ্ঞাগত: সংজ্ঞাগত দিক থেকে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। যেমন- জাতীয়তা একটি মানসিক ধারণা যা জনসাধারণের মাঝে ঐক্যবদ্ধতার জন্ম দেয় এবং যা দ্বারা একটি জনসমাজ নিজেকে অন্য জনসমাজ থেকে পৃথক বলে ভাবতে শেখে। আর জাতি হচ্ছে কতিপয় জনসমষ্টি যারা জাতীয়তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করে এবং স্বাধীন।

২. সাংগঠনিক: জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে সংগঠনগত দিক থেকে পার্থক্য দেখা যায়। জাতীয়তা একটি মানসিক ধারণা, যা জনসাধারণের মধ্যে ঐক্যানুভূতি গড়ে তোলে। এতে কোন রাজনৈতিক সংগঠন নেই। কিন্তু জাতি গঠন কখনো রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া হয় না।

৩. উৎপত্তিগত: রাষ্ট্রচিন্তাবিদরা মনে করেন, Plato, Aristotle এর সময় থেকে জাতি সংগঠিত হতে শুরু করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদের ধারণা উৎপত্তি হয় ষোড়শ শতকে আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক Machiavelli এর দর্শন থেকে।

৪. ধারণাগত: ধারণাগত দিক থেকে জাতীয়তাবাদ হলো একটি মানসিক ধারণা, আর জাতি হচ্ছে মানসিক ধারণাসহ স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টা।

৫. পরিধিগত: জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পরিধিগত পার্থক্য বিদ্যমান। জাতীয়তা হলো জাতি গঠনের প্রাথমিক উপাদান। জাতীয়তার জন্য মানসিক ধারণাই প্রধান ভূমিকা পালন করে। কিন্তু জাতির পরিধি ব্যাপক। জাতি গঠনের জন্য জনসমাজ, মানসিক ঐক্যানুভূতি ও রাজনৈতিক সংগঠন প্রয়োজন।

৬. সাধারণ সূত্রের দিক থেকে: জাতীয়তা গঠনের জন্য কতকগুলো সাধারণ সূত্রের মিল থাকতে হয়। যেমন- ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি। কিন্তু জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন হয় জাতীয়তাবোধের।

৭. পর্যায়গত দিক থেকে: জাতীয়তা হলো একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। আর জাতি হলো জাতীয়তার চূড়ান্ত পর্যায়।

৮. সুসংহতের দিক থেকে: জাতীয়তা খুব বেশি সুসংহত নাও হতে পারে। কিন্তু জাতি সুসংহত হবে এবং স্বাধীন কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে।

৯. রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে: জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য হলো, জাতি বিশেষ রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন হয় কিন্তু জাতীয়তা তা হয় না।

১০. স্বাধীনতা: স্বাধীনতার দিক থেকে উভয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন- জাতি সংঘাতভাবে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আর জাতীয়তাবাদ হলো রাজনৈতিকভাবে সুসংবদ্ধ।

উপসংহার: পরিশেষে বলতে পারি যে, উপর্যুক্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদের ফলেই অনেক সময় জাতিতে পরিণত হয়। তাই আমরা Watkins এর সাথে একমত হয়ে বলতে পারি যে, রাজনৈতিক চেতনা গভীরতা প্রাপ্ত হলে তবেই জাতীয় জনসমাজ জাতীতে উন্নীত হয় এবং জাতি পরিণতি লাভ করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।