অথবা, উগ্র আতীয়তাবাদ রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয় আলোচনা কর।
অথবা, উগ্র আতীয়তাবাদ রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা উল্লেখ কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: জাতীয়তাবাদ একটি আধুনিক ধারণা। এর বিকাশ ঘটেছিল বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে এশিয়ায়। তবে জাতীয়তাবাদের জন্ম ইউরোপে এবং ইউরোপ থেকে এটি পরবর্তী সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকায় এসেছিল। একটি জনগোষ্ঠীর যখন একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব থাকবে, তখন জাতীয়তাবান পূর্ণতা লাভ করবে। এ জাতীয়তাবাদের আবির্ভাবে পথিবীর কোথাও একনায়কতন্ত্রের অবসান হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আবার কোথাও আদর্শ এই জাতীয়তাবাদ বিশ্ব সভ্যতার পক্ষে যুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ: জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে যখন কোন জাতি নিজেদের সকল কিছুকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, তখন তারা নিজেদেরকে অন্যান্য জাতি থেকে শ্রেষ্ঠ বলে বিশ্বাস করে এবং এভাবে জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ ধারায় প্রবাহিত হয়ে মিথ্যা জাত্যাভিমানে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার লক্ষ্যে তখন আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতেও দ্বিধাবোধ করে না, তখন তাকে উগ্র জাতীয়তাবাদ বলে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক উন্নয়নের অত্নরায়: জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বিভিন্নভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. সংকুচিত সংস্কৃতি: জাতীয়তাবাদ ভৌগোলিক সীমারেখাকে সীমিত করে, বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণের পথ রুদ্ধ করে দেয়। অথচ বিভিন্ন জাতি সংস্কৃতি সংমিশ্রণের ফলেই উন্নত সংস্কৃতি গড়ে উঠে, যা সভ্যতা বিকাশের জন্য সহায়ক।
২. মানবতাবিরোধী: উগ্র জাতীয়তাবাদের নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে অনেক সময় মানবিক নীতি বিসর্জন দিতে হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র সবসময় অন্যের উপর প্রভুত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়।
৩. যুদ্ধের সূচনা: যুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসকে বারবার ফাটল ধরিয়েছে। আর এ যুদ্ধকে অনুপ্রাণিত করেছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। এ উগ্র জাতীয়তাবাদের ছায়া ও স্বপ্ন ডেকে আনল বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রলয়ঙ্করী বিভীষিকা কাউকে রক্ষ্য করল না। সারা বিশ্বের রাজনৈতিক অবস্থা উল্টাপাল্টা হয়ে গেল।
৪. আজ্ঞরাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানে সহায়ক নয়: উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাব আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের পথ রুদ্ধ করে দেয়। সেজন্য উগ্র জাতীয়তাবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।
৫. আক্রমণাত্মক: উগ্র জাতীয়তাবাদী কোন রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে তা অহংকার ও ঔদ্ধত্যের বশবর্তী হয়ে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে হস্তক্ষেপ ও সামরিক আক্রমণে লিপ্ত হয়। এভাবে জাতীয়তাবাদ শেষ পর্যন্ত সম্রোজ্যবাদী লিন্দা বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
৬. জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রবিরোধী: উগ্র জাতীয়তাবাদ কোন জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু সে রাষ্ট্রের হথেষ্ট অর্থনৈতিক সম্পদ না থাকলে এ উগ্রতা কোন জাতিকে টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয় না। উগ্র জাতীয়তাবাদ একটি রাষ্ট্রকে যুদ্ধ-বিগ্রহের দিকে ঠেলে দেয়। এতে করে রাষ্ট্রের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।
৭. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিগৃহীতকরণ: উগ্র জাতীয়তাবাদ নীতি প্রয়োগের কতকগুলো বাস্তব অসুবিধা আছে। প্রত্যেক জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে বসবাসকারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে স্থানান্তরের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। তারা উগ্র জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা নিগৃহীত ও উৎপীড়িত হতে পারে।
৮. মানব সংস্কৃতির বিকাশে বাধা: উগ্র জাতীয়তাবাদ সুষ্ঠু মানব সংস্কৃতি বিকাশের প্রতিবন্ধক। এটি মানবসমাজের মুক্তচিন্তা প্রসারে চরম বাধা। যার ফলে রাজনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয় না।
৯. পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির সহায়ক: উগ্র জাতীয়তাবাদ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সন্দেহের সৃষ্টি করে। যার ফলে শাস্তি ও উন্নতির সম্ভাবনা হ্রাস পায় এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র একে অপরকে শত্রু মনে করে। উগ্র জাতীয়তাবাদ দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রকে একটা সংকটের দিকে নিয়ে যায়।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনায় বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদ নীতির যথেষ্ট রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। যেসব দেশে কোন জাতির উপর গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি করছে, সেসব দেশে জাতীয়তাবাদ অপরিহার্য। তবে উগ্র জাতীয়তাবাদ কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। উগ্র জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।