“উগ্র জাতীয়তাবাদ আধুনিক সভ্যতার হুমকিস্বরূপ” আলোচনা কর।

অথবা, উগ্র জাতীয়তাবাদ কী বিশ্ব সভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ?

অথবা, উগ্র জাতীয়তাবাদ কী সভ্যতার হুমকিস্বরূপ? যুক্তি সহকারে ব্যাখ্যা কর।

উত্তর: ভূমিকা: জাতীয়তাবাদ আধুনিক বিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এর উনোষ ঘটেছে শতাব্দীতে এবং পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীতে। জাতীয়তাবাদ বিশ্ব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে এবং নিজ নিজ সত্তা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করে। কিন্তু বর্তমানে জাতীয়তাবাদ বিকৃত রূপ লাভ করেছে। বর্তমানে জাতীয়তাবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদে রূপ লাভ করেছে। এজন্য জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উগ্র জাতীয়তাবাদ আধুনিক বা বিশ্ব সভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ: বিভিন্ন মনীষী ও চিন্তাবিদ জাতীয়তাবাদের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। অনেকের মতে, উগ্র জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতা ও বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ। যুক্তিসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. সভ্যতার সংকট: জাতীয়তাবাদের প্রতি গভীর অনুরাগের ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে সকল বিষয়ে উন্নত ধারণা এবং অন্য জাতির সকল কিছুকে হেয় জ্ঞান জাতির মধ্যে দেখা দেয়। জাতির মধ্যে এক অন্ধ আবেগের সৃষ্টি হয় এবং একেই বলে উগ্র জাতীয়তাবাদ। এর ফলে জাতির মনে নিজের সম্পর্কে গর্ববোধ এবং অপর জাতির প্রতি ঘৃণা জন্মায়। এভাবে বিকৃত রূপ ধারণ করে জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে হিংসা, ঘৃণা ও বিদ্বেষের সম্পর্ক সৃষ্টি করে। এর ফলে মানবসভ্যতা সংকটের সম্মুখীন হয়।

২. সাম্রাজ্যবাদের আশংকা: উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রবণতার তাড়নায় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী না দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের উপর প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায়। ফলে জাতীয়তাবাদ তখন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে এবং নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্বল রাষ্ট্রসমূহ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের উপনিবেশে পরিণত হয়। অধ্যাপক লাঙ্কির মতে, “ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়।”

৩. অগণতান্ত্রিক: জাতীয়তাবাদের এ উগ্র, হিংস্র ও বীভৎস প্রকাশ গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও সমস্ত মানবিক চেতনার পরিপন্থি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকটস্বরূপ।” বলা যায় উগ্র জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।

৪. বিশ্বশান্তির বিরোধী: উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে ক্ষতিকর। এ ধরনের জাতীয়তাবাদ সর্বক্ষেত্রে স্বদেশ ও স্বজনের দাবিকে অগ্রাধিকার দেয়। ন্যায়-অন্যায়, যুক্তি ও আলাপ আলোচনাকে অস্বীকার করা হয় এবং সর্বপ্রকার বিরোধ মীমাংসার জন্য যুদ্ধের পথ গ্রহণ করা হয়। এ যুদ্ধবাদী প্রবণতা বিশ্বশান্তির ঘোরতর শত্রু।

৫. সংকীর্ণতার সৃষ্টি করে: উগ্র জাতীয়তাবাদ অন্ধ আবেগ ও উন্মাদনার সৃষ্টি করে। এর ফলে দেশ ও জাতির সবকিছুকে একটি বাধাধরা নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করা হয়। এভাবে বাইরের জ্ঞানবিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির আলো নিজস্ব সংস্কৃতিতে প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষে, বিকৃত জাতীয়তাবাদ হলো জাতির এক রোগ বিশেষ।

৬. বুর্জোয়া শ্রেণির হাতিয়ার: প্রকৃত প্রস্তাবে, ধনতন্ত্রের বিকাশের পর্যায়েই জাতীয়তাবাদ বিকৃত রূপ ধারণ করে। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার পূর্বে বুর্জোয়া শ্রেণি জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। অধ্যাপক হায়েস এর মতানুসারে, “Nationalism is artificial and it is far from ennobling, in a word it is patriotic snobbery.”

৭. মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা: উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে মারণাস্ত্রের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। জাতীয়তাবাদ মহান আদর্শ থেকে বিচ্যুড় হলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা দেখা দেয়। ফলে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন হয়।

৮. অনৈতিহাসিক: জাতীয়তাবাদের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বলে অনেক রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন। তারা মনে করেন জাতীয়তাবাদ জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও প্রগতি রক্ষার সহায়ক। এ জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে মনে করা হয় বিশ্বের বুকে অনেক রাষ্ট্রেই জাতীয়তাবাদের চেতনা থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র ও স্বাধীন স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে।

৯. অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার: জাতীয়তাবাদের সম্প্রসারণ অর্থনৈতিক শোষণের পথকে সুগম করে দেয়। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদের ধারণা সাম্রাজ্যবাদী চেতনার জন্ম দেয়। আর সামাজ্যবাদী চেতনা অর্থনৈতিক শোষণের তিয়ার হিসেবে কাজ করে। এজন্য জাতীয়তাবাদের উগ্র চেতনা মানব সভ্যতার সহায়ক নয়, পরিপন্থি।

১০. নিরাপত্তার পরিপন্থি: জাতীয়তাবাদের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হলে নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাহত হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে অহংকারবোধ ও গর্ববোধ বৃদ্ধি পায়। এতে অহংকারী রাষ্ট্র নিজস্ব নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রকে আঘাত করে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার সমৃদ্ধি ও উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সংকীর্ণ বা উগ্র জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়ে মানবসভ্যতার সংকট সৃষ্টি করে। সুতরাং আদর্শ জাতীয়তাবাদ তার কল্যাণকর প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে একটি মহান রাষ্ট্রনৈতিক আদর্শ হিসেবে গণ্য হয়’। আর উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ তার সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানবসভ্যতার শত্রু হিসেবে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়। বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদই সভ্যতার জন্য চরম হুমকিস্বরূপ, আদর্শ জাতীয়তাবাদ নয়। অর্থাৎ আদর্শ জাতীয়তাবাদ সর্বদা শাস্তির কথা বলে। পক্ষান্তরে উগ্র জাতীয়তাবাদ শাস্তির বিপক্ষে কথা বলে এবং রাষ্ট্রকে ভাংসের পথে নিয়ে যায়।