জনসংখ্যা নীতি-২০০০ অনুযায়ী জনসংখ্যা নীতি প্রণয়নের প্রেক্ষাপট উল্লেখ কর।

অথবা, জাতীয় জনসংখ্যা নীতি-২০০০ অনুযায়ী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: জনসংখ্যা নীতি প্রণয়নের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনমান উন্নান ও উৎকর্ষ সাধন। এ নীতির মুখ্য উদ্দেশ্য বাংলাদেশের জনমিতিক গতি প্রকৃতি পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে সামাজিক অর্থনৈতিক ও পরিবেশ উন্নয়নের অনুকূলে পরিকল্পনা করা। এ নীতি দেশের জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে যেমন অবদান রাখবে। তেমনি অব্যাহত উন্নয়নের লক্ষ্যে ধারণাযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে।

জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণয়নের প্রেক্ষাপট: ম্যালথাসের তত্ত্বানুযায়ী জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। ফলে বৃদ্ধির দ্রুততা অত্যন্ত বেশি। পৃথিবীজুড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশ্লেষণ এর সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। এ থেকে সুস্পষ্ট যে শেষোক্ত দশকগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো (১৯৮৭-১৯৯৯) মাত্র ১২ বছর বিশ্ব জনসংখ্যা ৫০০ কোটি থেকে ৬০০ কোটি হয়েছে। ১৯৯৮ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, “১৯৮৮-১৯৯৯ মাত্র ১২ বছর বিশ্ব জনসংখ্যা ৫শ কোটি থেকে ৬শ কোটি হবে-জনবিস্ফোরণ রোধে এগিয়ে আসুন।”

জনসংখ্যার এই পরিকল্পিত বৃদ্ধির ফলে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তার শুধু একটি বিষয় হচ্ছে অকাল গর্ভধারণ জনিত কারণে বিপুল সংখ্যক মায়ের অকাল মৃত্যু, শুধুমাত্র গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর ৬ লাখ মহিলা অর্থাৎ প্রতি মিনিটে একজন মহিলার মৃত্যু ঘটেছে। মৃত্যুর সময় এসব মায়েরা ১০ লাখ শিশুকে অসহায় অবস্থান ফেলে রেখে যায়। এ সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে শিশুমৃত্যু, বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগত সমস্যাসহ অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, বনভূমিসহ ভূমির উপর বর্ধিষ্ণু চাপসহ পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপাট সম্ভবত এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের চাইতে ভয়াবহ। বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি ক্ষুদ্র জনবহুল দেশ। আয়তনিক বিশ্লেষণে বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের পৃথিবীর মোট স্থলভাগের মাত্র ০.১৩ শতাংশ। অথচ এখানে বসবাস করছে মোট জনসংখ্যার ২.২ শতাংশ ঘনত্বের বিচারে বাংলাদেশের, স্থান প্রথম (প্রতিবর্গ কিলোমিটার ৯০০ জনের মত)। অবশ্য সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত UNFPA এর প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ। সে হিসেবে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বর্তমানে ১০০০ জনেরও বেশি (প্রায় ১০৪০ জন) বসবাস করে।

জনসংখ্যার এ ক্রমবৃদ্ধি বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ১৯৪১-৫১ দশকের মধ্যবর্তী সময়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রত্যক্ষ করে কিছু সমাজ সচেতন, প্রগতিশীল ও মানব হিতৈষীদের প্রচেষ্টায় জনসংখ্যা কার্যক্রম শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকের পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমশ উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে থাকলে বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে দৃষ্টি আর্কষণ করে। ফলে এ সরকারি পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

এ সময়ে জনসংখ্যা কার্যক্রমকে স্বাস্থ্য সার্ভিসের অংশ হিসেবে সম্পৃক্ত করা হয় এবং স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র যেমন-হাসপাতাল, ডিসপেনসারী এবং ক্লিনিকের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বা জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। ১৯৬৫-৭০ সালে মাঠ ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসিত পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। স্বাধীনতা উত্তম পর্যায়ে ১৯৭২-৭৪ অন্তর্বর্তীকালীন সমন্বিত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এ সময়ে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধিকে দেশ পুনর্গঠন ও উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করে একে দেশের এক নম্বর জাতির সমস্যা হিসেবে ঘোষণা হয় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির অপরিমিত গতিকে কার্যকরভাবে রোধকল্পে জাতির জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন করা হয়।

জাতীয় জনসংখ্যা নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ নিম্নে জাতীয় জনসংখ্যা নীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ আলোচনা করা হলোঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জীবনযাপনের গুণগত মানের উপর যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, তা কমিয়ে আনার জন্য নিম্নবর্ণিত সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রথমতঃ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় ও উত্তম স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমূলক সেবা পৌঁছে দেয়া, জনসাধারণ বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল ও শহরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী জন্য সহজলভ্য পরিবার পরিকল্পনা ও অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।

দ্বিতীয়ত, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা আরও জোরদার ও গতিশীল করার লক্ষ্যে কার্যকর প্রযুক্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণ।

তৃতীয়ত, আগামী ২০০৫ সালের মধ্যে রিপ্লেসমেন্ট লেভেল অর্জন করা এবং বর্তমান শতাব্দীর মাঝামাঝি স্থায়ী জনসংখ্যা অর্জন করা।

চতুর্থত, জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ করে শিশু ও মহিলাদের অপুষ্টির হার হ্রাস করা এবং তাদের কাছে খাদ্য ও স্বাস্থ্য শিক্ষা পৌঁছানোর জন্য কার্যকর সমন্বিত কর্মসূচি প্রদান। দেশে বর্তমানে বিদ্যমান শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৯০ এর মাত্রা থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে অর্ধেক ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জন করা।

পঞ্চমত, নারীর প্রতি সহিংসতাজনিত কারণে দৈহিক ও মানসিক আঘাতের জন্য যেসব সেবা ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন
সে ব্যাপারে সকল স্তরের স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মকর্তাদের সচেতনতা নিশ্চিতকরণ।

ষষ্ঠত, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত মহিলা ও শিশু স্বাস্থ্যর উন্নতির জন্য সন্তোষজনক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যত শীঘ্র সম্ভব প্রতিটি গ্রামে নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন সন্তান প্রসব সংক্রান্তি বিষয়সহ সুযোগ- সুবিধার ব্যবস্থা করা। প্রতিটি থানা হেলথ কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে সার্বক্ষণিক ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য সহযোগী কর্মকর্তা/ কর্মচারীর উপস্থিতি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ওষুধপত্র সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।

সপ্তমত, পরিবার পরিকল্পনা সেবার গুণগতমান উন্নয়ন ও জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বা ব্যবহারকারীর সন্তুষ্টি নিশ্চিতকরণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়া, প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সুযোগ-সুবিধাদি তথ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সর্বাধিক উন্নয়ন।

অষ্টমত, জটিল অবস্থার সেবার জন্য জনসাধারণ যাতে সরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারে তার উপায় উদ্ভাবন এবং বিভিন্ন পর্যায়ে হাসপাতালসমূহের ব্যবস্থাপনা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও প্রদত্ত সেবার মান সন্তোসজনক পর্যায়ে রাখার ব্যবস্থা করা। বিশেষ করে জীবন রক্ষাকারী তাৎক্ষণিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা।

নবমত, অতি দরিদ্র ও অতি অল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। সহজলভ্য ও কার্যকর করার পন্থার উদ্ভাবন। মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা।

দশমত, পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনাকে আরও দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে জবাবদিহিতামূলক ও ব্যয়সাশ্রয়ী করার পন্থা নির্ধারণ।

একাদশতম, প্রজনন ও মৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়ার জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনার কারণে সরকারের সর্বস্তরের কর্তৃপক্ষ তাদের মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদি আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনাসমূহের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর বিষয়টি বিবেচনায় রাখা, জরাগ্রস্ত বৃদ্ধদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতির মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি সমর্থন ও সেবার সংস্থান অন্তর্ভুক্ত করা।

দ্বাদশতম, নগরায়ণের আশংকাজনক অবস্থা মোকাবেলার জন্য সমন্বিত উপায়ে ভারসাম্যময় জনসংখ্যা বণ্টন নীতি
প্রণয়ন করা, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ গ্রহণ ও প্রেরণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে উন্নয়নের অন্যান্য লক্ষ্য, নীতি এবং মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই নীতি প্রণয়ন নিশ্চিত করা, উৎপাদন কর্মসংস্থান এবং জনসংখ্যার মধ্যে স্থানগত ভারসাম্য অর্জনের জন্য অব্যাহত আঞ্চলিক উন্নয়ন ও নগরকে পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে শক্তিশালী করার কৌশল গ্রহণ।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, জাতীয় জনসংখ্যা নীতি-২০০০ বাস্তবায়ন করার জন্য যে সকল উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা সেগুলো সঠিকভাবে প্রণয়ন ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।