অথবা, জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০০০ অনুযায়ী জনসংখ্যা কার্যক্রমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কি ভূমিকা পালন করে আলোচনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: বাংলাদেশের সমাজ উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন করেছেন। এসব নীতির বাস্ত বায়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক নীতিগুলো এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কতটুকু অর্থপূর্ণ উন্নয়ন সাধন করবে তা বিবেচ্য বিষয়। এ নীতিগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা নীতি যুব উন্নয়ন নীতি, শিশু কল্যাণ নীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, শিক্ষানীতি উল্লেখযোগ্য। এসকল নীতিগুলোর বিশেষত্ব হলো সংশ্লিষ্ট সমস্যা দূর করা
এবং সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
জনসংখ্যা কার্যক্রমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাঃ উচ্চ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং একই সাথে জনসংখ্যা আকারের বৃদ্ধি অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের লক্ষ্য অর্জনের প্রক্রিয়ার বাধার সৃষ্টি করে। তাই যে সকল মন্ত্রণালয় এবং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠী জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, সে সকল মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম অংশীদার করে নেয়া উচিত। এ লক্ষ্য অর্জনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মপরিধির মধ্যে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। নিচে জনসংখ্যা কার্যক্রমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা উল্লেখ করা হলোঃ
১. স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ কার্যক্রমের নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রণালয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে এবং জেলা পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থিত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন হাসপাতাল ও অন্যান্য সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে এবং মাঠকর্মীদের সহায়তায় পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করবে।
২. প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী উন্নতমান বজায় রেখে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাক্রম সম্পন্ন করতে পারে। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষা নারী-পুরুষের সমতা উৎসাহিত করার কার্যক্রম চালু রাখা এবং শক্তিশালী করা যেতে পারে। উপরন্তু বিভিন্ন পাঠ্যক্রমে জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান শিক্ষা, জীবন দক্ষতা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ সময় উপযোগী করে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে পাঠ্যক্রমসমূহ প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিবর্তন করার জন্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা যেতে পারে।
৩. কৃষি মন্ত্রণালয়কে এর অধিনস্থ কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহে জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে। এ মন্ত্রণালয় তাদের সম্প্রসারণ কর্মীদের মাধ্যমে কৃষিকাজে নিয়োজিত জনগণকে ছোট পরিবার গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।
৪. তথ্য মন্ত্রণালয়কে রেডিও টেলিভিশনের মাধ্যমে বিশেষভাবে যুব সমাজের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা পরিবার পরিকল্পনা মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং প্রজনন স্বাস্থ্য, নারী-পুরুষের তারতম্য যৌনরোগ ও এইচ আইডি/ এইডস সম্পর্কে তথ্য প্রচারে অধিক সময় ও সম্পদ বরাদ্দ করার জন্য উৎসাহিত করা হবে। পাশাপাশি এ সব বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য Print Media ভূমিকা জোরদার করতে হবে।
৫. স্থানীয় সরকার পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় জনসংখ্যা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে গ্রাম সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের সদস্য ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করার কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারে। বয়স্ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে প্রজনন স্বাস্থ্য ও নারী-পুরুষের তারতম্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে মন্ত্রণালয় জনসংখ্যা কার্যক্রমের জন্য মহিলা সমবায় সমিতিগুলোর ব্যবহার অব্যাহত রাখতে পারে।
৬. পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন নীতিনির্ধারণ, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের পরিকল্পনা ও কর্মসূচিতে জনসংখ্যার উপাদানসমূহের অন্তর্ভুক্ত কারণসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের কাজে সমন্বয় সাধন করবে। এ মন্ত্রণালয় সার্বিকভাবে জাতীয় প্রচেষ্টা ও কর্মসূচির প্রভাব মূল্যায়নের কাজও সম্পাদন করবে। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান নূরো প্রতিবছর পর পর আদমশুমারি পরিচালনা এবং জনসংখ্যা বিষয়ক পরিসংখ্যান জনমিতিক তথ্য সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবে।
৭. সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় যুব ও ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় মহিলাদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, মহিলাদের জন্য প্রাপ্ত ঋণ সহায়তার ব্যবস্থাকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এবং মহিলাদের অধিকার ও দায়িত্বের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সম্পর্কে মহিলা ও যুব উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
৮. পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় জাতীয় পরিবেশ নীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বৃক্ষরোপণ জনগণকে উৎসাহিত করা, বনাঞ্চলে জনবসতি স্থাপনে নিরুৎসাহিত করা, পরিবেশ দূষণকারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা এবং উন্নত প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে।
৯. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হাসপাতাল এবং অন্যান্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে পারে এবং তাদের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের জন্য নিয়মিত শিক্ষামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারে।
১০. শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানসমূহ, শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, চা-বাগানের ক্লিনিকসমূহ এবং অন্যান্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচি চালু করতে হবে।
১১. ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে ধর্মীর নেতা ও ইমামদের দায়িত্বশীল অভিভাবকত্ব, পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসহ স্বাস্থ্যসেবা ও যৌনরোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদানের কার্যক্রম জোরদার করতে পারে।
১২. ভূমি মন্ত্রণালয় আদর্শ গ্রাম, ছিন্নমূল ও বস্তি পুনর্বাসনসহ মন্ত্রণালয় পরিচালিত বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচিতে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য, তথ্য ও সেবা কার্যক্রম চালু করতে পারে।
১৩. শিল্প মন্ত্রণালয় সরকারি ও বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য পরিবার পরিকল্পনা, ও প্রজনন স্বাস্থ্য তথ্য ও সেবা প্রদানের ব্যবস্থার মাধ্যমে বিবাহিত শ্রমিকদের দেরিতে বিবাহে উৎসাহিত করা এবং পরিকল্পিত পরিবার গঠনে সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে।
১৪. বিজ্ঞান ও তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ই গভর্নেন্স কর্মসূচির ওয়েব-সাইট জনসংখ্যা বিষয়ক তথ্য প্রচারে উদ্দোগু গ্রহণ করতে পারে। এ মন্ত্রণালয়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যক্রম জনসংখ্যা পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
১৫. যোগাযোগ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হাসপাতাল ও অন্যান্য সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে পারে এবং তাদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য নিয়মিত শিক্ষামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করতে পারে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ও এর ক্ষতিকর বা বিরূপ প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকার উপরোক্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ ও প্রজনন সেবা প্রদানে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে।