অথবা, জাতীয় শিশুনীতি ২০১০ সম্বন্ধে আলোচনা কর।
উত্তর : ভূমিকা : শিশু জাতি গঠনের মূলভিত্তি। স্বাধীনতার পর সুখী, সমৃদ্ধ, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বক্ষেত্রে সকল শিশুকে পূর্ণ মর্যাদাবান মানুষরূপে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩৪, ৩৭, ৩৮, ৩৯,৪০,৪১এ সকল নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। বিশেষ করে অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এ শিশুদের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ বিধান প্রণয়ন করার বিষয় সন্নিবেশিত হয় শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়। শিশু আইন ১৯৭৪, ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে ১৯৮৯ (United Nations Child Right Convention (CRC) অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ সংবিধান এবং জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে বর্ণিত শিশুদের সার্বিক কল্যাণ বিবেচনার ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন করা হয়।
জাতীয় শিশুনীতি-২০১০ বাংলাদেশের শিশুদের বর্তমানে একটি সুদূরপ্রসারী রূপকল্প হলোঃ
১. শিশু: শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সি বাংলাদেশের সকল ব্যক্তিকে বুঝায়। দেশের প্রচলিত কোন আইনে এর ভিন্নতা থাকলে এ নীতির আলোকে প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে সামঞ্জস্য বিধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
২. বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরী: ১০ বছর থেকে ১৮ বছরে কম বয়সী বয়সন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরীদের
বিকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করা হবে।
৩. পরিধি: জাতীয় শিশুনীতি পিতা-মাতা বা আইনগত অভিভাবকের লিঙ্গগত, ধর্মীয়, জাতিগত, পেশাগত, সামাজিক, আঞ্চলিক ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নির্বিশেষে বাংলাদেশের নাগরিক ও এ নীতির আওতাধীন সকল শিশু ও বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর- কিশোরীর ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনভাবে প্রযোজ্য হবে।
৪. মূল্যনীতিঃ বাংলাদেশ সংবিধান ও আন্তর্জাতিক সনদসমূহের আলোকে শিশু অধিকার নিশ্চিতকরণ।
(ক) শিশুদের দারিদ্রদ্র্য বিমোচন।
(খ) শিশুর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণ।
(গ) শিশু অধিকার বাস্তবায়নে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ।
(ঘ) শিশুর সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে শিশুদের অংশগ্রহণ ও মতামত নিশ্চিতকরণ।
৫. লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ জাতীয় শিশু নীতি নিম্নলিখিত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন ও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রণীত হয়েছেঃ
৬. আইনি প্রণয়ন: শিশু অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিবিধানের প্রণয়ন করা হবে।
৭. শিশু সুরক্ষাঃ শিশু অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা শিশুর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য ও নির্যাতন দূরীকরণের মাধ্যমে সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
৮. শিশুর সর্বোত্তম উন্নয়নঃ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, নিরাপত্তা বিনোদন ও অন্যান্য অধিকারের ক্ষেত্রে শিশুদের সর্বোত্তম উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে।
৯. শিশুদের মতামতের প্রতিফলন: ও শিশু ও বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরীর জীবনকে প্রভাবিত করে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নকে তাদের মতামতের প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে।
১০ লিঙ্গ সমতা আনয়নঃ কন্যা শিশুর বিশেষ প্রয়োজন ও অধিকারসমূহের স্বীকৃতি প্রদান, সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা হবে।
১১. দায়িত্বশীল নাগরিক: উপযুক্ত শিক্ষা ও পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে শিশুদের দেশ সম্পর্কে আরও আগ্রহী ও সচেতন করে গড়ে তোলা হবে।
১২. বিজ্ঞান মনস্ক প্রজন্ম : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার অপরিহার্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে শিশুদের একটি বিজ্ঞান মনস্ক প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
শিশু অধিকার বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ: শিশুর নিম্নলিখিত অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা ও সুরক্ষিত রাখার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
১. শিশুর নিরাপদ জন্ম ও সার্বিক বিকাশ নিশ্চিতকরণ: সকল শিশুর নিরাপদ জন্মগ্রহণ ও বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গর্ভবর্তী ও প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও পরিকল্পনা সেবার পাশাপাশি শিশুর নিরাপদ জন্ম ও বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা নেয়া।
২. শিশু স্বাস্থ্যঃ সকল শিশুর জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্প্রসারিত টিকা প্রদান কার্যক্রম (EPI) শৈশব, অসুস্থতার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা (IMCI) ও নবজাতক স্বাস্থ্য (NBH) ও সময় উপযোগী অন্যান্য কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
৩. শিশু শিক্ষাঃ বর্তমানে প্রচলিত প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে শিশুর প্রারম্ভিক শৈশব বিকাশ কার্যক্রম আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করা হবে।
৪. শিশুর দারিদ্র্য বিমোচনঃ শিশুর দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে পুষ্টি, স্বাস্থ্য, সার্বিক সুরক্ষা, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়কে অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে।
৫. শিশুর বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম: শিশুর জন্য মানসম্মত বিনোদন, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতির চর্চা সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ের জন্য খেলার মাঠ, এলাকাভিত্তিক শিশুপার্ক স্থাপন এবং নগর পরিকল্পনা আবশ্যিকভাবে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
৬. শিশুর সুরক্ষা: সকল প্রকার সহিংসতা নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে শিশুদের সুরক্ষিত থাকার অধিকার থাকবে। শিশুদের উপর সহিংসতা, নির্যাতন ও অবহেলা বন্ধ করার লক্ষ্যে কার্যকর জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
৭. প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ কার্যক্রম: জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী অধিকার সনদ অনুযায়ী সকল প্রতিবন্ধী শিশুর স্বীকৃতি ও সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
৮. অটিস্টিক শিশুর জন্য বিশেষ কার্যক্রম: অটিস্টিক শিশুদের অধিকাংশই স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। তাই তাদের সমাজে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
৯. শিশুর জন্ম নিবন্ধনঃ সকল শিশুর জন্মের অব্যাহিত পরেই জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিত করা হবে। জন্ম নিবন্ধন আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রচার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা হবে।
১০. সংখ্যালঘু ও আদিবাসী শিশুর জন্য বিশেষ কার্যক্রমঃ নৃতাত্ত্বিক ও সংখ্যালঘু শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশের সকল অধিকার নিশ্চিত করা হবে। নৃতাত্ত্বিক ও সংখ্যালঘু শিশু যাতে তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রেখে বিকাশ লাভকরতে পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১১. বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর- কিশোরীদের উন্নয়ন: বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর- কিশোরীদের দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। সে প্রেক্ষিতে তাদের সমস্যাসমূহ সমাধান ও তাদের মেধা ও ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
১২. শিভ্রম নিরসনের জন্য পদক্ষেপসমূহঃ শিশুদের শ্রমের নিয়োগে ব্যাপক বাধানিষেধ থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ও পারিবারিক প্রয়োজনে অনেক শিশু অতি অল্প বয়সে নানা ধরনের শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়। এই শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে দুস্থ ও নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থাসম্পন্ন শিশুদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষার পাশাপাশি মাসিক মাসোহারা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা পড়াশোনা হতে বিচ্ছিন্ন হতে না পারে।
বাস্তবায়ন কৌশল:
১. প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোঃ জাতীয় পর্যায়ে আইনের মাধ্যমে শিশুদের জন্য ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ দেয়া হবে। শিশুদের জন্য ন্যায়পাল’ জাতীয় কর্মসূচিতে শিশুদের অধিকার ও কল্যাণ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে এবং জাতিসংঘ সনদ বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণে ভূমিকা পালন করবে।
২. মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের সমন্বয়: প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, উপসচিব ও তদুর্ধ্ব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে শিশু বিষয়ক কার্যক্রম বিষয়ে সমন্বয়ে দাসত্ব প্রদান করা হবে।
৩. বেসরকারি ও সরকারি কর্মকাণ্ডের সমন্বয়: শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি উদ্যোগকে সুসংহত ও আরও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে বেসরকারি সংস্থাসমূহের সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা হবে।
৪. গবেষণা পর্যালোচনা ও পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন: ও শিশু বিষয়ক তথ্যাদির প্রয়োজন মাফিকসহ একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ প্রস্তুত সংরক্ষণ ও নিয়মিত হালনাগাদ করা হবে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, উপর্যুক্ত উদ্দেশ্য, কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিশু অস্ফিার নীতি ২০০৪ ফলপ্রসূ করা হয়।