প্লেটোর শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার তুলনামূলক আলোচনা কর।

অথবা, প্লেটোর শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে বর্তমান শিক্ষার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর।

অথবা, প্লেটোর শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সম্পর্ক আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: প্লেটের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার বেশকিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে সাদৃশ্য বৈসাদৃশ্যগুলো আলোচনা করা হলো:

ক. সাদৃশ্য: নিম্নে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আধুনিক শিক্ষার সাদৃশ্য বা মিলসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. ভরভিত্তিক: প্লেটো যেমন শিক্ষাকে বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত করে সুনির্দিষ্ট পাঠ্যসূচির কথা বলেছেন। আধুনিক কালেও অনুরূপ শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। প্লেটোর শিক্ষা ব্যবস্থার মতো বর্তমান কালেও প্রাথমিক ও উচ্চতর শিক্ষারব্যবস্থা বিদ্যমান।

২. নারী শিক্ষা: প্লেটো তার শিক্ষাতত্ত্বে নারী শিক্ষাকে স্থান দিয়েছেন এবং নারী শিক্ষার প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাতে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ রয়েছে।

৩. যোগ্যতার নীতি: প্লেটো শিক্ষাকে যোগ্যতার নীতির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনায় একটি তর থেকে আরেকটি স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য যোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে অনুরূপ নীতি অনুসরণ করা হয়।

৪. পরীক্ষা পদ্ধতি: শিক্ষার একটি স্তর থেকে আরেকটি স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য পূর্ববর্তী স্তর সফলভাবে সম্পন্ন করতে হয়। এরূপ সফলতা নির্ধারিত হয় পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে। প্লেটো তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাতেও যা অপরিহার্যভাবে গৃহীত হয়েছে।

৫. শিক্ষার বিষয়বস্তু: প্লেটো তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় যে সকল পাঠ্যবিষয়ের উল্লেখ করেছেন যেমন- গণিত, জ্যামিতি, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ইত্যাদি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও পাঠ্যবিষয় হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

৬. প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যায়াম ও সংগীতের উপর শুরুত্ব: প্লেটো তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনার প্রাথমিক স্তরে সংগীত এবং শরীর গ্রোকে গুরুত্বের সাথে স্থান দিয়েছেন। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক স্তরেও সংগীত এবং শরীর চর্চা শিক্ষা দেয়া হয়।

৭. বাধ্যতামূলক শিক্ষা: প্লেটো তাঁর শিক্ষাতত্ত্বে শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করার কথা বলেছেন। বর্তমান
কালেও বিশ্বের বহু দেশে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা চালু রয়েছে।

৮. রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা: প্লেটো শিক্ষার সকল দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করেছেন। শিক্ষার পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যয়ভার সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। বর্তমান কালে বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এরূপ নীতি অনুসরণ করা হয়। এভাবে দেখা যায় যে, আজ থেকে বহু বছর আগে প্লেটো শিক্ষাব্যবস্থার যে রূপরেখা অঙ্কন করেছেন তা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথে বহুলাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ। আজকের জাতীয় রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি প্রয়োগযোগ্য না হলেও আংশিক হলেও তার শিক্ষাব্যবস্থা বর্তমানে প্রয়োগযোগ্য। নিঃসন্দেহে তাঁর শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক দিকগুলোকে কখনো উপেক্ষা করা যাবে না।

খ. বৈশাদৃশ্য: নিম্নে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আধুনিক শিক্ষার বৈসাদৃশ্য বা অমিল বা পার্থক্যসমূহ আলোচনা করা হলো:

১. প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা ছিল নির্দিষ্ট শ্রেণীর জন্য। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা সকলের জন্য। ফলে প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা সার্বজনীন ছিল না। আর বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে সার্বজনীন।

২. প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল দক্ষ শাসক শ্রেণী গড়ে তোলা। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করা।

৩. প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সময়সাপেক্ষা। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা এত বেশি সময়সাপেক্ষ নয়।

৪. প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি রাষ্ট্র যারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ব্যক্তি উদ্যোগেও পরিচালিত হয়।

৫. প্লেটো তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় গণিত ও দর্শনের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন কিন্তু আধুনিক কালে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার উপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়।

৬. প্লেটোর শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সর্বাত্মকবাদী ও অগণতান্ত্রিক। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, প্লেটো তাঁর রিপাবলিক (Republic) গ্রন্থে শিক্ষা সম্পর্কে যে মতবাদ দিয়েছেন তা মৌলিক ও বিশিষ্টতাপূর্ণ। পরবর্তীকালের অনেক চিন্তাবিদ তাঁর শিক্ষাতত্ত্বের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। তিনি বহুবছর আগে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক নারী-পুরুষের যে শিক্ষা পরিকল্পনার কথা বলেছেন তা আজ – এতদিন পরেও বহুলাংশে প্রযোজ্য। তিনি তার শিক্ষাতত্ত্বে দেহ এবং মনের উৎকর্ষতা সাধনের জন্য যেরূপ শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন তা সর্বদাই প্রাসঙ্গিক এবং প্রশংসার দাবিদার। সত্যিই প্লেটোর শিক্ষাতত্ত্ব হচ্ছে তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি।