প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র গণতন্ত্র বিরোধী বা কল্পনাবিলাসী কি না আলোচনা কর।

অথবা, প্লেটোর দর্শনে আদর্শ রাষ্ট্র ছিল কাল্পনিক বা গণতন্ত্র বিরোধী ব্যাখ্যা কর।

অথবা, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা ছিল কল্পনা বিলাসী বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: বিশ্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থার অগ্রগতিতে ও সমাজ সভ্যতার উন্নয়নে যেসব মনীষীর অবদান বা চিন্তাধারা বর্তমান সমাজেও দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে আছে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। গ্রিক রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতা, দেশের যুদ্ধাবস্থা প্রভৃতির অবসানকল্পে প্লেটো তাঁর বিখ্যাত ‘The Republic’ গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দেন। প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা করতে গিয়ে তারই গুরু মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মূল নীতি ‘Virtue is Knowledge’ এবং ‘যা আদর্শ তাই বাস্তব’ প্রভৃতি নীতি দ্বারা যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত হয়েছেন। মূলত প্লেটো তাঁর ‘The Republic’ এ যে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছেন, তার মূল উদ্দেশ্য হলো সুন্দর বা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন। কিন্তু তাঁর এ আদর্শ রাষ্ট্রের চিন্তাধারাকে অনেকে অগণতান্ত্রিক এবং কল্পনাবিলাসী বা কাল্পনিক বলে অভিহিত করেছেন।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র গণতন্ত্র বিরোধী বা কল্পনাবিলাসী কি না: নিম্নে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র গণতন্ত্রবিরোধী বা কল্পনাবিলাসী কি না সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১. উৎপাদক শ্রেণিকে অবহেলা: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনায় উৎপাদক শ্রেণিকে চরমভাবে অবহেলা করেছেন। তাদের সামাজিক মর্যাদা না দিয়ে শুধু ভোগ্যবস্তু উৎপাদনের হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেছেন, যা গণতন্ত্রবিরোধী।

২. মানবপ্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনায় অভিভাবক শ্রেণির জন্য পরিকল্পিত সাম্যবাদের ব্যবস্থা করে মানব প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। কারণ মানুষ তার ইচ্ছা সত্ত্বেও পারিবারিক জীবন উপলব্ধি করতে পারছে না।

৩. অবাস্তব কল্পনা: প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনভার দার্শনিক রাজার হস্তে অর্পণ করে স্বর্গরাজ্যের সন্ধানে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, যা সম্পূর্ণভাবে গণতন্ত্রবিরোধী ও অবাস্তব কল্পনা।

৪. নিম্নশ্রেণিকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত: আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য প্লেটো যে শিক্ষাব্যবস্থার কল্পনা করেছেন, তাতে নিম্নশ্রেণির শিক্ষার কোন সুযোগ নেই, যার কারণে একে গণতন্ত্রবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

৫. অরাজক শাসনব্যবস্থা: প্লেটো গণতন্ত্রকে অরাজক শাসনব্যবস্থা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা গণতন্ত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্লেটোর মতে, “এ হচ্ছে অদ্ভুত রকমের এক অরাজক ব্যবস্থা, যেখানে সমান ও অসমান সকলেই সমান।”

৬. গণতন্ত্র নিকৃষ্ট ধরনের শাসনব্যবস্থা: প্লেটো গণতন্ত্রকে নিকৃষ্টতর শাসনব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ এখানে যোগ্যতার কোন মূল্য নেই। গণতন্ত্রে ধনীগরিব সকলেই সমান। সুতরাং এ শাসনব্যবস্থায় ভালো কিছু আশা করা
যায় না।

৭. ব্যক্তিত্ব খর্ব: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মূলনীতি হচ্ছে, “রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র নয়।” এ থেকে বুঝা যায় প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব খর্ব করা হয়েছে।

৮. নীতিহীন শাসনব্যবস্থা: প্লেটো বলেছেন, “গণতন্ত্র নীতিহীনতার শাসন। অন্যান্য শাসন বিকৃত হলেও একটা নীতি থাকে কিন্তু গণতন্ত্রে কোন নীতির বালাই নেই।”

৯. স্বৈরতন্ত্রের দিশারি: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে দার্শনিক রাজা। তিনি অভিভাবকদের দিয়ে রাষ্ট্রের শাসনকার্য সম্পাদন করবেন। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর স্বাধীনতা অর্পণ করা হয়েছে। এরূপ শাসন স্বৈরতন্ত্রের দিশারি ছাড়া আর কিছু নয়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মতবাদ গণতন্ত্র বিরোধী ও কাল্পনিক হলেও এটি অন্যায়, অবিচার ও কুশাসনের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। কেননা তৎকালীন গ্রিসের অরাজনৈতিকতা, বিশৃঙ্খলা এবং অবিচারের কথা চিন্তা করেই মূলত প্লেটো এ ধারণা ব্যক্ত করেন। তাঁর এ ধারণা বর্তমান কালের রাষ্ট্রচিন্তায়ও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে আছে। তাঁর এ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পরবর্তী কালে বহু রাষ্ট্র দার্শনিক বহু মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। পরিশেষে বলা যায়, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা একটি কাল্পনিক ও অগণতন্ত্রী ধারণা কিন্তু এর অবদান যথেষ্ট।