অথবা, বর্তমানকালে প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শনের বাস্তবতার প্রাধান্য ব্যাখ্যা কর।
অথবা, আধুনিককালে প্লেটোর রাষ্ট্রচিতার দিকগুলো বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: প্লেটো ছিলেন গ্রিক পণ্ডিত ও দার্শনিক সক্রেটিসের সুযোগ্য শিষ্য। জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যাদের অবদান চিরভাস্বর প্লেটো তাদের মধ্যে অন্যতম। প্লেটো খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭ অব্দে এথেন্সের এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অল্প বয়সেই সক্রেটিসের সাহচর্যে আসেন। তাঁর চিন্তাধারায় তিনি গভীরভাবে প্রভাবান্বিত হন। জ্ঞানবিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই, যেখানে তিনি বিচরণ করেন নি। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।
আধুনিককালে প্লেটোর রাষ্ট্রচিন্তার বাস্তব দিকগুলোর গুরুত্ব: আধুনিককাল পর্যন্তও প্লেটো, দার্শনিক, রাজনৈতিক চিন্তক, আইনবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদগণের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে চলেছেন। কোন একজন দার্শনিকের এমন ব্যাপক প্রভাব সচরাচর দেখা যায় না। প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের যে রূপরেখা অঙ্কন করেছেন তা যদিও ছিল কাল্পনিক, তথাপি তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামো বর্তমান অবস্থায় অনুসরণযোগ্য। তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের কাঠামোয় দার্শনিক শাসক, যোদ্ধা শ্রেণি ও উৎপাদক শ্রেণির কথা উল্লেখ করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশে অযোগ্য, অশিক্ষিত শাসকের কারণে দেশে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীতে লোকজন ঢুকতে অনীহা প্রকাশ করছে এবং উৎপাদক শ্রেণি ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এর ফলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। এ কারণে বর্তমানে যদি প্লেটোর রাষ্ট্রতত্ত্ব আমরা অনুসরণ করি, তাহলে সকল ক্ষেত্রে যোগ্য লোকের দ্বারা শাসনকার্য পরিচালিত হবে, যথাযথ যোদ্ধা শ্রেণি এবং উৎপাদক শ্রেণি গড়ে উঠবে। শিক্ষা সম্পর্কে প্লেটো যা বলেছেন আজও তা অম্লান। প্লেটোর মতে, “শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মনের সুষম বিকাশ সাধন।”
মানুষের মন উন্নত ও বিকশিত না হলে সমাজ উন্নত হতে পারে না। সাম্প্রতিক কালে এ বিষয়টার উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। ইউনেস্কোর সংবিধানে বলা হয়েছে যে, পৃথিবী থেকে যুদ্ধের সম্ভাবনা দূর করতে হলে মনকে উন্নত করতে হবে। বলাবাহুল্য, এটি প্লেটোর কথা। প্লেটো যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলেছেন তা আজও আমরা দেখতে পাই। কেবল সমাজতান্ত্রিক দেশে যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে তা নয়, উদারনীতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো একই নীতি অনুসরণ করছে। একই প্রকার শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা আমরা আজও অনুভব করি। প্লেটোর দার্শনিক রাজা মেধা ও উৎকর্ষতার প্রতীকমাত্র। পৃথিবীর সর্বত্রই আমলারা শাসনকার্যে নিযুক্ত, সাধারণ মানুষের কোন স্থান নেই। প্লেটোর যেমন দার্শনিক রাজা, আধুনিক যুগের তেমন আমলা সম্প্রদায়। প্লেটোর আমলে প্রশাসন এত জটিল ও বহুদূর বিস্তৃত ছিল না বলে একজন দার্শনিক রাজার পক্ষে শাসন চালানো সম্ভব ছিল। আজকের দিনে তা সম্ভব নয়। আমলাতন্ত্র তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছে।
প্লেটোর ন্যায়ধর্ম আধুনিক কালেও পরিলক্ষিত হয়। প্লেটোর মতানুসারে ন্যায়বিচার এমন একটি বিষয়, যা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করেও নিজ নিজ কর্তব্য পালনের কথা শিক্ষা দেয় এবং যার ফলে প্রত্যেকটি শ্রেণির লোকের সাথে মিশ্রিত হয়ে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা যায়। আধুনিককালের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ দেখি, তা প্লেটোর ন্যায়ধর্ম অনুসারেই প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতি যে পরিকল্পনা বর্জিত নয় তা প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ পড়লে বুঝা যায়। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে আজও আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করছি যে, রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন এবং সে অনুযায়ী প্রশাসন চালান। বিকাশ বা উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা করতে বহু রাষ্ট্রকে দেখা যাচ্ছে। সমাজবাদী রাষ্ট্রসমূহ অর্থনীতির ক্ষেত্রে পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। রাজনীতিও পরিকল্পনার এখতিয়ার থেকে বাদ যায় নি।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, এসব বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে প্লেটোর বাস্তববাদী চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যায়। কোথাও কোথাও তিনি কাল্পনিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তথাপিও বলার অপেক্ষা রাখে না প্লেটোর চিন্তাধারা এরিস্টটলের মতো অতটা বাস্তব না হলেও বাস্তবকে স্বীকার করেছেন। তিনি রাষ্ট্রচিন্তায় যে অবদান রেখে গেছেন তা আজও স্মরণীয়।