প্লেটোর রিপাবলিকের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শনের ধরন ব্যাখ্যা কর।

অথবা, প্লেটোর রিপাবলিকের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মহান দার্শনিক প্লেটো রচিত ‘দি রিপাবলিক’ (The Republic) বিশ্ব সাহিত্যের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এ গ্রন্থের মাধ্যমে প্লেটো রাষ্ট্রনীতির যে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন, তা আজও বিশ্বে বিরল অবদান বলে স্বীকৃত আছে। গ্রিক নগরসভ্যতার সাথে প্লেটো ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সমাজ ও রাজনীতির সাথে ছিল তার বাস্তব সম্পর্ক। গ্রিক নগররাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে প্লেটো যে সমস্যা কন্টকাকীর্ণ জীবনের মধ্যে বাস করেছেন, মূলত রিপাবলিক হচ্ছে তা থেকে মুক্তির প্রয়াস। গ্রিক নগররাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা যখন অভিজাততন্ত্র, কতিপয়তন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের চক্রাবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তখন আদর্শ রাষ্ট্রের নীল নকশারূপে ‘The Republic’ শাষকদের সামনে আবির্ভূত হয় নতুন দিনের আলো নিয়ে।

রিপাবলিকের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ: নিম্নে প্লেটোর রিপাবলিকের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:

১. আদর্শ রাষ্ট্র: প্লেটোর ‘The Republic’ এর মূল লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি। এ রাষ্ট্রীয় সংহতি বজায় রাখার জন্য তিনি এক আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেন। এখানে তিনি গোটা সমাজকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথাঃ ক. দার্শনিক; খ. যোদ্ধা ও গ. উৎপাদক শ্রেণি। এ তিন শ্রেণির লোক রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করবে। এখানে কেউ নিজের খেয়ালখুশিমতো কাজ করবে না। রাষ্ট্র নির্দেশিত পথে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আদর্শ রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণির স্বার্থে সৃষ্ট। এজন্য বলা হয়, “Everything for the state, nothing beyond the state, nothing above the state.”

২. ‘দুই সত্য’ তত্ত্ব: প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে আলোচিত বিষয়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর ‘দুই সত্য’ বা ‘দুই জগৎ’ তত্ত্বের। একটি জগৎ হলো পরিদৃশ্যমান নিত্যকার জগৎ। অন্যটি হলো এ দৃশ্যমান জগতের উৎস, যা চিরন্তন, অদৃশ্য ও অপরিবর্তনীয়। প্লেটো মনে করেন, “এ অপার্থিব অদৃশ্য জগৎই চরম সত্য।”

৩. ন্যায়বিচার: প্লেটোর ‘The Republic’ গ্রন্থের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা প্রধান আলোচ্যবিষয় হলো ন্যায়বিচার (Justice)। ন্যায়বিচার সম্পর্কিত প্লেটোর বক্তব্য রিপাবলিকের কোন বিশেষ একটি অংশে কেন্দ্রীভূত নয়। ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থটির সামগ্রিক আলোচনার মধ্য থেকেই ন্যায়ের ধারণাটি তৈরি করা যেতে পারে। প্লেটোর কাছে ‘ন্যায়’ দয়া, মহত্ত্ব, সাহস কিংবা জ্ঞান নয়। এগুলো হলো রাষ্ট্র বা ব্যক্তির বিশেষ গুণাবলি। প্লেটো বলেছেন, “ন্যায়কে বৃহৎ আকারে প্রত্যক্ষ করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।” অর্থাৎ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য রাষ্ট্রে ‘ন্যায়’ আবিষ্কৃত হয়েছে। তাঁর মতে, যা কিছু সর্বোত্তম রাষ্ট্রের অনুকূলে তাই ন্যায়বিচার।

৪. দার্শনিক রাজার শাসন: প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসনতত্ত্ব প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে। তাঁর এ বক্তব্যের জন্য তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে কল্পনাবিলাসী হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন। যাহোক, প্লেটোর যুক্তি হচ্ছে যেহেতু শাসক সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী, তাই কোন আইনের বাধা তার কার্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। শাসক নিজের প্রজ্ঞা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। সেজন্য প্লেটোর দার্শনিক রাজার শাসনকে স্বৈরাচারী বলে আখ্যায়িত করা হয়।

৫. শিক্ষাব্যবস্থা: প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে শিক্ষানীতি বা শিক্ষাব্যবস্থার উপর ব্যাপক আলোচনা করেছেন। প্লেটোর মতে, “শিক্ষার মাধ্যমেই নাগরিকদের প্রকৃতি প্রদত্ত গুণাবলির উন্মেষ ও বিকাশ সাধিত হবে।” শাসকগণ শিক্ষাপ্রাপ্ত হলে আইন, শাসন ও বিচারের বিষয়ে কোন চিন্তার কারণ থাকবে না। তিনি বলেছেন, উত্তম শিক্ষা লাভকারী শাসক অধর্মের কাজ করতে পারে না। সুতরাং দর্শন শাস্ত্রের জ্ঞান ছাড়া দার্শনিক শাসক তৈরি হতে পারে না।

৬. সাম্যবাদ: শাসক শ্রেণির সাম্যবাদ সম্পর্কে প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। শাসক শ্রেণির সাম্যবাদ বিষয়টিকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব বলা যায়। রাষ্ট্রের শাসন সংক্রান্ত দায়িত্ব নির্বিঘ্নে পালন করার লক্ষ্য নিয়ে প্লেটো অভিভাবক শ্রেণির অর্থাৎ শাসক ও সেনাবাহিনীর জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পরিবার ব্যবস্থার বিলুপ্তির প্রস্তাব করেছেন। রাষ্ট্রের ঐক্যের জন্য এবং শাসক ও সেনাবাহিনী, অর্থাৎ অভিভাবক শ্রেণি যাতে নিঃস্বার্থভাবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেজন্য অভিভাবকদের ব্যক্তিগত পরিবার ও সম্পত্তি থাকতে পারবে না। অভিভাবক শ্রেণির জন্য প্লেটোর এ প্রস্তাবই ‘প্লেটোর সাম্যবাদ’ নামে অভিহিত।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, প্লেটোর ‘Republic’ নীতিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কিত একটি একক গ্রন্থ। এখানে মানুষকে চিন্তা করা হয়েছে রাষ্ট্রের সভ্য হিসেবে, আর রাষ্ট্রকে চিন্তা করা হয়েছে একটি নৈতিক সংগঠন হিসেবে। ‘রিপাবলিক’ মূলত বাস্তব উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত একটি গ্রন্থ: ‘Republic’ মনের দর্শন। তবে তা কেবল মনকে বিশ্লেষণ করার জন্য নয় মানুষকে সতর্ক করা ও পরামর্শ দেয়ার জন্যও। এ গ্রন্থে প্লেটো মানুষের মুক্তির জন্য সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন। সুতরাং প্লেটো সম্পর্কে জ্ঞান লাভের আবশ্যকতা বর্তমান যুগেও রয়েছে একথা বলা যায়।