এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

অথবা, এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধর।

অথবা, এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতি উল্লেখ কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মহান গ্রিক দার্শনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। Prof. Gettell বলেছেন, “Aristotle holds on enviable place in the annuals of political philosophy.” এরিস্টটল তাঁর সুবিখ্যাত ‘Politics’ গ্রন্থে কেবল সংবিধানের তুলনামূলক পর্যালোচনাই করেন নি বরং কোন ধরন্নেদা সরকার সর্বাপেক্ষা ব্যস্তবধর্মী তাও চিহ্নিত করেছেন। এরিস্টটল তাঁর শিক্ষাগুরু প্লেটোর মত কল্পনাবিলাসী ছিলেন না। তিনি বস্তুবাদী বা বাস্তববাদী ছিলেন। তাই একটি আদর্শ রাষ্ট্র বা বাস্তবসম্মত রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তিনি প্রচেষ্টা চালান। আর এ প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি এরিস্টটলের সর্বাপেক্ষা বাস্তবধর্মী রাষ্ট্র ‘Polity’ বা ‘মধ্যতন্ত্র’।

এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য: এরিস্টটল তাঁর ‘Politics’ গ্রন্থে বাস্তবসম্মত বা সর্বোত্তম বা আদর্শ রাষ্ট্রের কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্নে সেগুলো আলোকপাত করা হলো:

১. আয়তন ভারসাম্যপূর্ণ: এরিস্টটলের মতে, আয়তনের দিক থেকে ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া আদর্শ রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্র কতটা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে কি না তার উপরই তাদের ভালোত্ব নির্ভর করে। তিনি আরও বলেছেন, রাষ্ট্র বেশি বৃহাদাকার হলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা কঠিন। আবার বেশি ক্ষুদ্রাকার হলেও তার কারিফত স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ব্যর্থ হবে। সুতরাং, আয়তনের দিক থেকে রাষ্ট্রের মাঝামাঝি আয়তনকেই শ্রেয় বলে মনে করা হয়।

২. নিয়মতান্ত্রিকতাবাদ প্রতিষ্ঠা: ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রের শাসনভার অর্পণ না করে আইনের হাতে শাসনভার অর্পণ করে তিনি নিয়মতান্ত্রিকতাবাদের সূচনা করে গেছেন। এছাড়া এরিস্টটল সরকারের বিভিন্ন রূপের মধ্যে সমন্বয় করে যে পলিটি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন তা নিয়মতান্ত্রিকতারই প্রকাশ। নিয়মতান্ত্রিকতাবাদের ফলে আইনের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৩. জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন: আদর্শ রাষ্ট্রের সংবিধানে জনসাধারণের আশা-আকারকার বাস্তব প্রতিফলন থাকতে হবে। মানুষের সুখী, সুন্দর ও সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনের জন্য প্রতিটি আনুষঙ্গিক বিষয় হলো বাহ্যিক মঙ্গল, শারীরিক মঙ্গল ও আত্মার মঙ্গল। এ তিনটি অনুযদের মধ্যে কোনটি তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে।

৪. আইনের শাসন: এরিস্টটল তাঁর সর্বাপেক্ষা বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রের আলোচনার কোন ব্যক্তি বা বাড়িমণ্ডলীকে গুরুত্ব দেয়ার পরিবর্তে আইনের উপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর মতে, একজন শাসক ব্যক্তি হিসেবে যতই জ্ঞানী বা গুণী হোক না কেন, আইনকে বাদ দিয়ে তার পক্ষে শাসন করা সম্ভব নয়। কারণ শুধু নীতিশাস্ত্র দিয়ে মানুষের পশুত্বকে বশ করা যায় না, এজন্য প্রয়োজন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।

৫. জনসংখ্যার সীমা নির্ধারণ: আদর্শ রাষ্ট্রের অধিবাসীর সংখ্যা এরূপ হতে হবে, যাতে তা আইন শৃঙ্খলাজনিত সমস্যার সৃষ্টি না করে স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রয়োজন মিটাতে পারে। তাছাড়া নাগরিকেরা যাতে প্রত্যেকে প্রত্যেককে চিনতে ও জানতে পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জনসংখ্যার সীমা নির্ধারণ করতে গিয়ে এরিস্টটল শুধু মুক্তজন্ম নাগরিকদের কথাই চিন্তা করেছেন, অনাগরিকদের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

৬. ভৌগোলিক অবস্থান: ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে রাষ্ট্র হবে সমুদ্রকূল সংলগ্ন। এর ফলে বিদেশিদের অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা থাকলেও সামরিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সরবরাহ নিশ্চিত করা সহজতর হবে।

৭. সুষ্ঠু পরিকল্পনা: এরিস্টটল যে আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা করেছেন তা সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রণীত হবে। এ পরিকল্পনা প্রণয়ন কালে যেসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে সেগুলো হলো জনস্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা, রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার অনুকূল পরিবেশ এবং বাহ্যিক সৌন্দর্যবোধ।

৮. সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা: এরিস্টটলের সর্বোত্তম রাষ্ট্রে শিক্ষা হবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। তিনি মনে করতেন যে, শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। শিশুদের বাল্যকাল থেকে এমনভাবে শিক্ষিত করতে হবে, যাতে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

৯. সমাজকাঠামোর প্রকৃতি: এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রে বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তিরা স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত থাকবে। এ রাষ্ট্রে কৃষক খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করবে, ব্যবসায়ী ব্যবসায় করবে, সৈনিক যুদ্ধ করবে, দাস মালিকের হুকুম তামিল করবে, কারিগর যন্ত্র তৈরি এবং সরকারি কর্মচারী সরকারি দায়িত্ব পালন করবে।

১০. সরকার নিয়ন্ত্রিত বিবাহ ব্যবস্থা: সর্বোত্তম রাষ্ট্রে বিবাহ ব্যবস্থা সরকারি আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত বয়সের আগে বিবাহ করা যাবে না। স্বাস্থ্যগত বা প্রকৃতিগত কারণে যদি কেউ বিবাহের অযোগ্য হয় তাহলে, তাকে বিবাহ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। সন্তান প্রজননের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মেনে চলতে হবে এবং অপরপক্ষে কোন বিকলাঙ্গ সন্তানের যাতে জন্ম না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

১১. মধ্যবিতের শাসন: একটি আদর্শ রাষ্ট্রে ধনী, দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত সকল শ্রেণির জনগণই বসবাস করে। ধনিক শ্রেণি ক্ষমতায় গেলে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। দরিদ্র শ্রেণির দাসোচিত মনোভাব থাকে বলে তারা শাসনকার্য পরিচালনায় অনুপযুক্ত। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধনিক শ্রেণির উগ্র মনোভাব, এবং দরিদ্রের দাসোচিত মনোভাব থেকে মুক্ত। কাজেই সর্বোত্তম রাষ্ট্রে মধ্যবিত্তের শাসনই উপযুক্ত।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, এরিস্টটল সর্বাপেক্ষা বাস্তবধর্মী বা সর্বোত্তম বা আদর্শ রাষ্ট্রের যে চিত্র অঙ্কন করেছিলেন তা বর্তমান যুগে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য না হলেও এর অবদান একেবারেই কম নয়। তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তা বর্তমানে অনেক রাষ্ট্রেই প্রতিফলিত হচ্ছে। যেমন- আইনের শাসন, নিয়মতান্ত্রিকতাবাদ, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদি। মূলত তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ছিল, “State came into being for the sake of life but continues for the sake of good life.” তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এরিস্টটলের সর্বোত্তম রাষ্ট্রের ধারণা একটি অনবদ্য সৃষ্টি।