অথবা, মধ্যতন্ত্রের সমর্থনে এরিস্টটলের যুক্তি ব্যাখ্যা কর।
অথবা, এরিস্টটল কেন মধ্যবর্তী শাসন ব্যবস্থা সমর্থন করেছেন বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক Aristotle ৩৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সের অন্তর্গত স্ট্যাগিরা নামক ক্ষুদ্র ঔপনিবেশিক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাস্তববাদী দার্শনিক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক হিসেবে পরিচিত। কেননা তিনি সর্বপ্রকার সংবিধানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন, যে কোন ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয়। তাই তিনি সরকার ব্যবস্থা বা সংবিধানের ক্ষেত্রেও মধ্যপন্থা অবলম্বনের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসনকে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা বা সরকার বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ তাঁর মতে, Polity বা মধ্যতন্ত্র হলো সর্বাপেক্ষা বাস্তবধর্মী ও উত্তম সরকার ব্যবস্থা। কেননা সমাজের বেশিরভাগ লোক মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
মধ্যতন্ত্রের সপক্ষে এরিস্টটলের যুক্তি: এরিস্টটল মধ্যতন্ত্রকে সমর্থন করে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি মধ্যতন্ত্রের সপক্ষে যেসব যুক্তি তুলে ধরেছেন সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার: Polity বা মধ্যতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার। এরিস্টটল বলেছেন, “সংখ্যার মধ্যে আমরা নিরাপত্তা লক্ষ্য করতে পারি। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যে শাসনব্যবস্থায় উপকৃত হয়, তাই উত্তম শাসনব্যবস্থা।” সাধারণত একটি রাষ্ট্রে মধ্যবিত্ত সংখ্যায় বেশি। তাই রাষ্ট্রের সুশাসনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার অর্থাৎ মধ্যতন্ত্র একান্ত অপরিহার্য।
২. যথোপযুক্ত সরকার ব্যবস্থা: বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের জনসাধারণকে সাধারণত তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা: ধনী, মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। ধনিক শ্রেণির মধ্যে স্বেচ্ছাচারী শাসনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। দরিদ্র শ্রেণি শাসনের অনুপযুক্ত এবং তাদের মনোবৃত্তি অত্যন্ত নিচুমানের। এ দুই পরস্পরবিরোধী শ্রেণির যে কোন একটি শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দিবে। এজন্য এরিস্টটল মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসনব্যবস্থাকে যথোপযুক্ত সরকার ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারণ তারা সংখ্যায় বেশি এবং তারা জ্ঞানবুদ্ধিতে কোন অংশে কম নয়।
৩. শাসনকার্য পরিচালনায় দক্ষ: মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাষ্ট্র পরিচালনায় অধিক দক্ষতার পরিচয় দেয়। কেননা মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধনিক শ্রেণির উগ্র স্বভাব এবং দরিদ্র শ্রেণির দাসোচিত মনোভাব থেকে মুক্ত। এজন্য এরিস্টটল মধ্যতন্ত্রকে সবচেয়ে দক্ষ শাসনব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করেছেন।
৪. মানবিক গুণাবলির বিকাশ সম্ভব: এরিস্টটলের মতে, “Polity বা মধ্যতন্ত্র হলো উত্তম শাসনব্যবস্থা বা সরকার ব্যবস্থা।” মধ্যমতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের সুপ্ত প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব। কেননা এখানে ধনিক শ্রেণির উর্ধ্বচাপ কিংবা দরিদ্র শ্রেণির নিম্ন প্রবণতার সুযোগ নেই। তাই মধ্যতন্ত্রী মানবিক গুণাবলির বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক: মধ্যমতন্ত্রের মূলনীতি হলো এটি রাষ্ট্র ও জনগণ উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা, যা প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। কেননা মধ্যবিত্ত শ্রেণি হলো ধনী ও গরিবের মধ্যবর্তী অবস্থিত শ্রেণি। তাই রাষ্ট্রের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য এরা সবসময় রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। যার ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
৬. রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব রক্ষায় সহায়ক: মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরিস্টটল মনে করেন, ধনিকতন্ত্র ও গণতন্ত্র উভয়ই এক প্রকার অস্থিতিশীল সমতায় অবস্থান করে। ফলে প্রত্যেকেই নিজের সীমা লঙ্ঘন করে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এর ফলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং এর স্থায়িত্ব বিনষ্ট হতে পারে। তাই এ অবস্থায় রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য মধ্যতন্ত্র তথা মধ্যবিত্তের শাসন অপরিহার্য।
৭. দেশ রক্ষায় সহায়ক: মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগণ সবচেয়ে বেশি দেশপ্রেমিক। তারা দেশকে রক্ষার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকে। এরিস্টটলের মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগণ এত দরিদ্র নয় যে, তাদেরকে অবহেলা করা যায়। আবার তারা ধনী নয় যে, জনগণের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। তাই এ শ্রেণির জনগণ এমন এক বৃহৎ গোষ্ঠী গড়ে তুলবে যারা উক্ত দেশকে একটি জনপ্রিয় ভিত্তি দান করবে। সুতরাং রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য মধ্যতন্ত্র প্রয়োজন।
৮. শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক: এরিস্টটলের মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগণ খুব বেশি বিত্তশালীও নয়, আবার একেবারে বিত্তহীনও নয়। তারা ঐশ্বর্য ও দারিদ্র্যের মধ্যে অবস্থান করে বলে তাদের হাতে নিশ্চিতভাবে শাসনভার অর্পণ করা সম্ভব। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে শাসনভার অর্পণ করলে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা সম্ভব হবে।
৯. নিরাপদ সরকার ব্যবস্থা: মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসনব্যবস্থা নিরাপদ সরকার ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। কেননা বিপ্লব
প্রতিরোধে মধ্যশ্রেণির শাসন সবচেয়ে উত্তম। ধনিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে দরিদ্র জনগণ বিদ্রোহ বা বিপ্লব সংঘটিত করতে পারে। আবার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদীরা বিপ্লব ঘটাতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্রে নিরাপদ শাসনের জন্য মধ্যতন্ত্র বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির শাসনই সবচেয়ে বেশি কাম্য।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পলিটি এর ধারণাটির অভিনবত্ব এবং ব্যঞ্জনা তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রগুলোর ১৫৮টি সংবিধান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এরিস্টটল পলিটি এর কাঠামো প্রদান করেন। এরিস্টটল তাঁর দর্শনে মধ্যতন্ত্র বা মধ্যবিত্ত শাসন ব্যবস্থাকেই উত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে সমর্থন করেছেন।