দাসত্বপ্রথা সম্পর্কে এরিস্টটলের মতের বিস্তারিত বিবরণ দাও।

অথবা, এরিস্টটলের দাসপ্রথা মতবাদের ব্যাখ্যা কর।

অথবা, এরিস্টটলের দাসপ্রথা উল্লেখ কর।

উত্তর: ভূমিকা: রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে এরিস্টটলের যাবতীয় চিন্তাচেতনা সংকলিত হয়েছে তাঁর ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থের মধ্যে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটি একটি কালজয়ী গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, সমাজ বিচ্যুত হয়ে কোন মানুষ বাস করতে পারে না। সমাজ ও রাষ্ট্রেই মানুষের যাবতীয় সত্তার বিকাশ ঘটে। সমাজের বাইরে অবস্থান করে নৈতিক উন্নতি অর্জন করা অসম্ভব। তিনি বলেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রের অবস্থান ব্যক্তির উপরে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সুনাগরিক তৈরি করা। নীতিতে ও ধর্মে উন্নত করে নাগরিকদের জীবনে পূর্ণতা দান করাই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। এরিস্টটল রাষ্ট্রের নাগরিকদের বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন এবং দাসত্ব প্রথা সম্পর্কে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

দাসত্বপ্রথা সম্পর্কে এরিস্টটলের মত: ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থের প্রথম পুস্তকে এরিস্টটল দাসত্বপ্রথা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি ছিলেন দাসপ্রথার সমর্থক। দাসপ্রথার সমর্থন করে তিনি বলেছেন, দাসপ্রথা একটি চিরাচরিত ও স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ ক্রীতদাসরা কম বুদ্ধিবৃত্তির অধিকারী। এজন্য তাদের দ্বারা তেমন কোন উচ্চতর কাজ আশা করা যায় না, তাদের দ্বারা কেবল নিকৃষ্ট কাজ করাই সম্ভব। এ প্রসঙ্গে F. Thilly তাঁর ‘A History of Philosophy (Page-117) গ্রন্থে বলেছেন, “জন্ম, বংশ ও ব্যক্তিগত যোগ্যতার দিক থেকে নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাদের এ পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে ন্যায়পরতারও পার্থক্য হয়ে থাকে।” (Citizens differ in personal capability, in property qualifications, in birth and freedom, and justice demands that they be treated according to these differences.)

দাসদাসীদের কর্মক্ষেত্র: এরিস্টটলের মতে, দাসদাসীরা হলো রাষ্ট্রের সম্পত্তিবিশেষ, তারা সংস্কৃতি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা জানে না, তাই তাদের কায়িক শ্রমই একমাত্র কাজ বলে এরিস্টটল মনে করেন। এরিস্টটল দাসদাসীদের কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ করে, বলেছেন, পরিবারের দেখাশুনা, ধনসম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও দাসত্ব করা অর্থাৎ প্রভুর সেবা করা এর মধ্যেই দাসদাসীদের কর্মক্ষেত্র সীমিত। তিনি দাসপ্রথা সমর্থন করলেও গ্রিকরা কেউ দাসদাসী হোক এটা তিনি কখনো চান নি। এ প্রসঙ্গে F. Thilly তাঁর ‘A History of Philosophy’ (Page-118) গ্রন্থে বলেছেন, “তিনি দাসত্বকে একটি স্বাভাবিক বিষয় বলে বিবেচনা করেন। তবে যেসব বিদেশি গ্রিসে বসবাস করে তিনি এ প্রথাকে তাদের জন্য উপযুক্ত বলে মনে করতেন।” (He justifies slavery on the ground that it is a natural institution; it is just that foreigners, who alone composed the slave class in Greece.)

এরিস্টটলের মতে ব্যক্তিগত সম্পতি সুখের উৎস: এরিস্টটল ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে যাবতীয় সুখের উৎস বলে মনে
করতেন। এজন্য তিনি ক্রীত দাসদাসীদেরও রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মানুষ পরিশ্রম করে ধনসম্পদ উপার্জন করে। কাজেই ধনসম্পদ হচ্ছে পরিশ্রমের ফল উপভোগের মাধ্যম। তাঁর মতে, ধনসম্পদ মানুষকে একদিকে যেমন আনন্দ দেয়, অন্যদিকে আবার সভ্য হতে সহায়তা করে। তিনি বলেছেন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলোপ হলে মানুষ আবার অসভ্য জীবনে ফিরে যাবে।

এরিস্টটল ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী একজন চিন্তাবিদ। জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তাঁর অবদান রয়েছে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও দাসপ্রথার মতো একটা নিকৃষ্ট প্রথাকে তিনি কেন সমর্থন করেছিলেন তা বোধগম্য নয়। ছোটবেলা থেকে তিনি রাজকীয় পরিবেশের ছত্রছায়ায় বড় হয়েছিলেন। তাই তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় অভিজাততন্ত্রের প্রতি সমর্থন লক্ষ্য করা যায়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, এরিস্টটল ক্রীতদাসদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে এক ধরনের উন্ন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। অথচ মানবজাতির জন্য দাসপ্রথা খুবই লজ্জাজনক এবং অমানবিক। একজন মানুষ তার ন্যূনতম মানবিক অধিকার পাবে না, তার কোন ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকবে না, এটা হতে পারে না। দাসপ্রথা জঘন্য বিধায় বর্তমান সভ্য যুগে এটা নেই বললেই চলে। অতএব এরিস্টটলের দাসপ্রথা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়।