অথবা, প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হিসেবে স্বীকৃত- আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: মানুষের জীবনের সাথে রাষ্ট্রীয় জীবনের অভিন্ন সম্পর্ক স্থাপন করে একদিন এরিস্টটল একটি উন্নত ও সুসংবদ্ধ মানবজীবনের কল্পনায় প্রথম অনুভব করেন যে, মানুষ সামাজিক জীব আর সামাজিক কাঠামোতেই মানুষকে বাস করতে হবে। আর সে কারণে তিনি রাষ্ট্রীয় জীবনে এমন বিধিব্যবস্থার উদ্ভাবন করেন, যা সর্বাবস্থায় সর্বকালের মানুষের উন্নত জীবনের পক্ষে সহায়ক হবে। আমরা জানি না এরিস্টটল এর কল্পনা কতটুকু সার্থক হয়েছে। তবে অনুমান করি, আজ হতে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে জন্ম নিয়েও এরিস্টটল রাষ্ট্রদর্শনে যে বক্তব্য রেখে গেছেন তা সর্বকালের রাষ্ট্রদর্শনের মৌলিক অনুভূতি হিসেবে থাকবে।
মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব: মানুষ জন্মগ্রহণ করে আপন অবয়বে, সামাজিক জীব হিসেবে এবং সামাজিক কাঠামোতে। মানুষ এ সমাজে জন্মগ্রহণ করে বয়ঃপ্রাপ্তি লাভ করে এবং এক সময় এ সমাজেই মৃত্যুবরণ করে। তাকে সামাজিক জীব হিসেবে অন্যান্য পারিপার্শ্বিক জীবের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং সামাজিক কাঠামোর বিধিবিধান মেনে চলতে হয়। মূলত জন্মের পর থেকেই প্রকৃতিগতভাবে সে সমাজের সাথে খাপখাইয়ে এবং রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান মেনে চলতে শেখে। তাই এরিস্টটল বলেছেন, “মানুষ জন্মগতভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব।” উক্তিটির ব্যাখ্যা নিম্নরূপ:
১. অধিকার ও কর্তব্য পালন: মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হিসেবে সমাজের বা রাষ্ট্রের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই কিছু দায়িত্ব পালন করে। আর এরূপ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই সে তার অধিকার ভোগ করে। যেমন-আমার যেমন পথ চলার অধিকার আছে ঠিক, তেমনি অপরের উচিত আমার পথে বাধা সৃষ্টি না করা। এখানে মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই কাউকে তার চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে না। সুতরাং মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব হিসেবে অধিকার ভোগ এবং দায়িত্ব পালন করে।
২. রাষ্ট্র স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান: এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে, রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে কোন মানুষ মনুষ্যোচিত জীবনযাপন করতে পারে না। তিনি বলেছেন, মানুষ মূলত একটি ‘রাজনৈতিক জীব’ এবং এটা প্রকৃতিরই বিধান যে, রাজনৈতিক জীব হিসেবে সে রাষ্ট্রের সদস্য না হয়ে জীবনযাপন করতে পারে না। যদি এমন কোন লোক দেখতে পাওয়া যায় যে, সে কোন রাষ্ট্রের সদস্য নয়, তাহলে জানতে হবে যে, সে একটি মানুষ্যতর পশু কিংবা মনুষ্যোর্জ দেবতা।
৩. মানুষের জন্ম সমাজে: প্রাচীনকাল থেকে সমাজব্যবস্থা প্রচলিত। মানুষ জন্ম লাভ করে সমাজেই। সামাজিক জীব হিসেবে সে সমাজেই জন্মগ্রহণ করে এবং সমাজের মধ্যেই সে বেড়ে উঠে এবং মৃত্যুবরণ করে। সমাজের কাঠামোর মধ্যে সে পরিচালিত হয় প্রকৃতিগতভাবেই। সুতরাং মানুষ জন্মগ্রহণই করে সামাজিক জীব হিসেবে।
৪. রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান মেনে চলা: এরিস্টটল বলেছেন, মানুষ জন্মগতভাবেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতাধীন। রাষ্ট্রের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেই সে রাষ্ট্রীয় আইন, বিধিবিধান, প্রথা প্রভৃতি মেনে চলতে শেখে। এগুলো মেনে চলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ এগুলো রাষ্ট্রের মধ্যেই কোন চাপ বা বলপ্রয়োগ ছাড়াই মেনে চলতে শেখে।
৫. সমাজই আত্মিক সম্পর্ক গড়ার স্থান: সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ আত্মিক সম্পর্ক একে অপরের সাথে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে। আর এ সম্পর্ক গড়ে উঠে কোন আনুষ্ঠানিক নিয়মনীতি ছাড়াই। এটা মানুষের জন্মের পর হতেই চলতে থাকে।
৬. রাষ্ট্রের মাধ্যমেই লক্ষ্য অর্জন: রাজনৈতিক জীব হিসেবে প্রকৃতিগত দিক দিয়ে রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির কোন বিরোধিতা থাকতে পারে না। কারণ একমাত্র বাষ্ট্রের সদস্য হিসেবেই ব্যক্তি তার জীবনের পরমতম লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম।
৭. পরিবার গঠন: মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই পরিবার গঠন করে। পরিবারের প্রতি টান অনুভব করে। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। পরিবার গঠন সম্পর্কে বলতে গিয়ে এরিস্টটল বলেছেন যে, পুরুষ ও নারীর পাশাপাশি বা একত্রে বসবাস করার প্রবণতা প্রকৃতি প্রদত্ত। এ আকাঙ্ক্ষা বা প্রবণতা থেকে কেউ নিষ্কৃতি পেতে পারে না।
৮. সংঘবদ্ধ জীবনের প্রকাশ: এরিস্টটল বলেছেন, মানুষের সংঘবদ্ধ জীবনের প্রকাশ ঘটে মানুষের জন্মের পর থেকেই। মানুষ প্রথমে একটি বাসস্থান, একজন স্ত্রী ও একটি বলদ বা ক্রীতদাস চায়। এ নিয়ে তার সংঘবদ্ধ জীবনের শুরু। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী এরা একসাথে বসবাস করে এবং গঠিত হয় পরিবার। এভাবেই সংঘবদ্ধ জীবনের প্রকাশ ঘটে। সংঘবদ্ধ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না।
৯. পারিবারিক ধারা বজায় রাখা: বংশ রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্যই পুরুষ সামাজিক ন্যায়নীতির দ্বারা আবদ্ধ। সে জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ন্যায়নীতি এবং আচারব্যবহারের দ্বারা পরিচালিত। এটা মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবেই গড়ে উঠে।
১০. সামাজিক ন্যায়নীতি যারা আবদ্ধ: এরিস্টটল বলেছেন, মানুষ সামাজিক ন্যায়নীতির দ্বারা আবদ্ধ। সে জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ন্যায়নীতি এবং আচারব্যবহারের দ্বারা পরিচালিত। এটা মানুষের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবেই গড়ে উঠে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সৃষ্টির পর থেকেই মানুষ প্রকৃতির আওতাধীন। প্রকৃতিগতভাবেই সে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। সমাজের মধ্যেই তার বসবাস, বৃদ্ধি এবং মৃত্যু। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে নয়। জন্মের পর থেকেই তাকে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। সে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কিছু করতে পারে না। তাই এরিস্টটল বলেছেন, “The state belongs to a class of objects which exists in nature, it is his nature to live in a state.” সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনায় আমরা একথা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, “মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব” এবং যারা সমাজে বা রাষ্ট্রে বসবাস করে না তারা হয় পশু, না হয় দেবতা।”