সেন্ট অগাস্টিনের ‘দুই তরবারি তত্ত্ব’ আলোচনা কর।

অথবা, সেন্ট অগাস্টিনের দুই তরবারি তত্ত্ব কী?

অথবা, সেন্ট অগাস্টিনের দুই তরবারি তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।

অথবা, সেন্ট অগাস্টিনের Theory of Two Swords ‘দুই তরবারি তত্ত্ব’ সম্পর্কে যা জান লিখ।

উত্তরঃ ভূমিকা: রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সাথে খ্রিস্টধর্মের স্বীকৃতি ও বহুদেববাদের প্রতি ধিক্কার যাদের সমর্থন লাভ করতে ব্যর্থ হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সেন্ট অগাস্টিন। তিনি ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার ট্যাগাস্টি নামক শহরে জন্যগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন প্যাগান ধর্মাবলম্বী কিন্তু মাতা ছিলেন খ্রিস্টান। অগাস্টিন নিজেও প্রথম জীবনে একজন প্যাগান ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। সাধারণ পাণ্ডিত্য ও ধর্মজ্ঞানের জন্য তিনি হিপ্লোর বিশপ’ নিযুক্ত হন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে ‘De Civiate Dei’ বা ‘The City of God’-ই হচ্ছে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এ গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়েই এক নতুন যুগের স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করে, যার নাম মধ্যযুগ। এ মহান দার্শনিক ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বিবৃত বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে একটি অন্যতম তত্ত্ব হলো ‘দুই তরবারি তত্ত্ব’ (Theory of Two Swords) যা আমাদের বর্তমান আলোচনার মূল বিষয়বস্তু।

সেন্ট অগাস্টিনের দুই তরবারি তত্ত্ব: সেন্ট অগাস্টিন খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি ছিলেন চরম পোপপন্থি। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন গির্জার স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। আধ্যাত্মিক ব্যাপারে গির্জা এবং পার্থিব ব্যাপারে রাষ্ট্রের স্বায়ত্তশাসন ও একের ব্যাপারে অন্যের হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার যে নীতি তিনি ঘোষণা করেন সেটিই সাধারণভাবে ‘দুই তরবারি তত্ত্ব’ (Theory of Two Swords) নামে পরিচিত।

সর্বপ্রথম দুই তরবারি তত্ত্বের ব্যাখ্যা প্রণীত হয় পোপ প্রথম গেলাসিয়াস কর্তৃক। তিনি বলেছেন যে, ধর্মীয় ব্যাপারেব সম্রাট যাজকের অধীন এবং এ ব্যাপারে তাঁর শুধু শেখার আছে, শিক্ষা দেয়ার কিছু নেই। পক্ষান্তরে, পার্থিব ব্যাপারে সাম্রাজ্যের মধ্যে যেসব আইনকানুন প্রচলিত আছে, যাজক সেগুলো মানতে বাধ্য। তবে তুলনামূলকভাবে পার্থিব সংস্থার কর্মকর্তাদের চেয়ে গির্জার কর্মকর্তাদের গুরুত্ব অধিক, কারণ তাদেরকে রাষ্ট্রের শাসক সমেত সকল লোকের জন্য স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করতে হয়, কিন্তু শাসককে সেরূপ কিছু করতে হয় না। পার্থিব শাসকগণ তাদের মুক্তির জন্য রাষ্ট্রীয় যাজকদের উপর নির্ভরশীল। অপরপক্ষে, যাকজগণ যাতে তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারেন সেজন্য শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রয়োজন এবং সে শাস্তি ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হলে যাজক লোকদের ন্যায় তাদেরকেও আইনকানুন মেনে চলতে হয়।

যে কারণে তত্ত্বটিকে ‘দুই তরবারি তত্ত্ব’ নামে অভিহিত করা হয়েছে তা হলো, প্রাচীনকালের খ্রিস্টান যাজকগণের বিশ্বাস ছিল যে, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক সবরকম ক্ষমতার উৎস যে অদ্বিতীয় বিধাতা তিনি কর্তৃত্বের প্রতীকস্বরূপ একখান তরবারি দিয়েছেন সম্রাটকে আর একখান তরবারি দিয়েছেন পোপকে। এ তরবারির সাহায্যে সম্রাট প্রভুত্ব করবেন মানুষের বাহ্যিক জীবনের উপর, আর পোপ প্রভুত্ব করবেন মানুষের আত্মার উপর। স্বয়ং যিশুখ্রিস্ট কর্তৃক প্রচারিত বাণীর মধ্যেও এ তত্ত্বের মূল নিহিত রয়েছে। তাঁর বাণীটি হলো “সিজারের যা পাওনা তা সিজারকে দাও, আর খোদার যা পাওনা তা খোদাকে দাও।” দুই তরবারি তত্ত্বে রাষ্ট্র ও গির্জার ক্ষমতার মধ্যের কল্পিত সীমারেখা সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারলে হয়তো এ দুই শক্তির সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু এটি বাস্তবায়িত করা কোনদিনও যায় নি এবং ভবিষ্যতেও তা সম্ভব নয়। এর ফলে রাষ্ট্রের ধারণা হয় যে, গির্জা তার অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে। যার ফলশ্রুতিতে উভয় শক্তি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এ সংঘর্ষ চালু থাকে বেশ কয়েক শতাব্দীব্যাপী, যা ক্ষতবিক্ষত করে তোলে সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাসকে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার সারগর্ভ হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, ‘দুই তরবারি তত্ত্ব’টি মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত। পার্থিব বিষয়ের প্রধান হলেন রাজা এবং আধ্যাত্মিক জগতের অধিকর্তা হলেন পোপ এটিই এ তত্ত্বের মূল উপজীব্য। কালক্রমে পোপ গ্রেগরি ও অন্যান্যদের মতবাদের দ্বারা এ তত্ত্বের মূলে আঘাত হানা হয়। তখন বলা হয় যে, আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রেই সম্রাটের ক্ষমতা পোপের ক্ষমতার অধীন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে পোপের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে তাঁরা সচেষ্ট হন।