মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় গির্জা বনাম রাষ্ট্রের অর্থাৎ পোপ বনাম সম্রাটের আধিপত্য বিস্তার বা দ্বন্দ্বের কারণসমূহ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিতায় কেন গির্জা বনাম রাষ্ট্র তথা পোপ বনাম সম্রাটের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল আলোচনা কর।

অথবা, পোপ ও সম্রাটের মধ্যে মধ্যযুগে ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে পোপ সম্রাটের মধ্যে যে যন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল তার কারণগুলো বর্ণনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ। মধ্যযুগের একটা বিরাট অংশ জুড়েই ছিল এ বিরোধ। কিন্তু বাস্তবতার দৃষ্টিতে বিচার করলে এ দু’টি সংস্থার মধ্যে বিরোধ থাকার কথা নয়। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে উভয় সংস্থার একগুয়েমি, অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যান্য নানা কারণে বিরোধ দানা বেধে উঠেছিল এবং এক সময় তা প্রবল আকার ধারণ করেছিল। রাজা ও পোপ কেউ তাদের নিজের স্থানে সন্তুষ্ট ছিল না। ফলে গির্জা ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মোটকথা মধ্যযুগে গির্জা বনাম রাষ্ট্র, পোপ বনাম সম্রাট বা রাজা কেউ কারো অধীনে থাকতে চায় নি, যার যার মত আধিপত্য বা সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে। ফলে উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়েছে।

গির্জা বনাম রাষ্ট্র বা পোপ বনাম সম্রাটের আধিপত্য বিস্তার বা দ্বন্দ্বের কারণসমূহ: নিম্নে মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় গির্জা বনাম রাষ্ট্রের অর্থাৎ পোপ বনাম সম্রাটের বা রাজার দ্বন্দ্বের বা আধিপত্য বিস্তারের কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

১. উভয়ই পথভ্রষ্ট: মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, ধর্ম বা রাজনীতি কোনটাই নিজ নিজ পথে সঠিকভাবে চলে নি। পথভ্রষ্টতা বিরোধের অন্যতম কারণ। মধ্যযুগে জনগণ সিজার ও ভগবান যার যা পাওনা তাঁকে সেটুকু দিতে কুণ্ঠাবোধ করে নি। কিন্তু কেউই নিজ নিজ পাওনা পেয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। অধিক পাবার আশা উভয়কে এমনভাবে নেশাগ্রস্ত করে তুলেছিল যে শেষপর্যন্ত সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করেন নি। যতদিন পোপ ও অন্যান্য পুরোহিত সম্প্রদায় সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন ততদিন তারা জনগণের শ্রদ্ধা পেয়ে আসছিলেন। রাজাও প্রশাসন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে রাজা ও গির্জার মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু গির্জা সরল জীবন বাদ দিয়ে যখন পুরোহিতগণ বা পোপ বিলাসী হয়ে উঠল তখন রাজাও রাজকার্যে অবহেলা শুরু করে দিলেন। এ প্রসঙ্গে Maxey বলেছেন, “Church and the state soon discovered that their alliance was a marriage not of love but of convenience.” (Maxey- Ibid, P-110) এমতাবস্থায় রাজা ও পোপ আলাদা আলাদাভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন।

২. গির্জার সম্পদ বৃদ্ধি: মধ্যযুগে রাজশক্তি দুর্বল হওয়ায় অন্যান্য নানা শক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অন্যতম হলো সামন্ততন্ত্র। রাজার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রিক সম্পদের লুটতরাজে সামন্তপ্রভু ও গির্জার পুরোহিতকুল উভয়েই নেমে পড়েছিল। কিছুদিন পরে সামন্তপ্রভু ও জমিদারদের সাথে পোপের বা মোহান্তদের একটা গোপন ও অলিখিত ভাগবাটোয়ারা গড়ে উঠে। জনসাধারণের দান ও অন্যান্য নানা বেআইনি উৎস থেকে গির্জা বিপুল পরিমাণ সম্পদ আহরণ করে ফেলে। প্রয়োজনের তুলনায় আহরণ বেশি হলে অন্যান্য ক্ষেত্রে যা হয় গির্জায় তার ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়ায় নি। পার্থিব ভোগ লালসায় পুরোহিত বা মোহান্তরা এত বেশি ব্যস্ত থাকতেন যে, তাদেরকে কোন প্রকারে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি বলা যেত না। গির্জার এ বিলাসিতা সারা দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ঈর্ষার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে শাসক সম্প্রদায় গির্জার এ বিলাসিতাকে তীব্র সমালোচনা করে তারাও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছিল। ফলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছিল।

৩. পার্থিব জগতে অনুপ্রবেশের আকালঙ্কা: মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তায় অধ্যায়কে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে ধর্ম বা রাজনীতি স্ব-স্ব অবস্থান থেকে যেমনি বিচ্যুত হয়েছে, তেমনি নির্ধারিত পথেও তারা পরিচালিত হয় নি। মধ্যযুগে যাজকতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্বে পোপ ও পুরোহিত সম্প্রদায় সাধারণ অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যন্ত ছিল। ফলে তাদের প্রতি সাধারণ জনগণের ভক্তিশ্রদ্ধা ছিল সীমাহীন। অপরদিকে, রাজা ছিলেন সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ও পরাক্রমশালী প্রশাসক। ফলে রাজা অপেক্ষা মানুষ পোপকেই অধিক ভক্তিশ্রদ্ধা করতো। পোপের প্রতি অধিক সংখ্যক মানুষের আনুগত্য পোপকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তোলে। শুধু আধ্যাত্যিক জগতের শীর্ষে অবস্থানকে সে অকিঞ্চিৎতর মনে করে এবং একাই পার্থিব জগতের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার বাসনা প্রকাশ করে। রাজাও তার পার্থিব জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। নিজের প্রাপ্তির সীমানা অতিক্রম করে আরও বেশি পাওয়ার আকাংক্ষায় উভয়েই মত্ত হয়ে উঠে। শেষ পর্যন্ত রাজা ও পোপ সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

৪. কর স্থাপন: কর স্থাপনকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে গির্জা ও রাজার মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিয়েছিল। সানভাতান্ত্রিক প্রথায় গির্জার যাজকরা বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছিলেন এবং এ সূত্রে গির্জা নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্য জনগণের উপর কর চাপাত ও তা আদায় করতো। যাজকদের এ ক্ষমতা রাজাকে উত্তেজিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কারণ একদিকে রাজার ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ, অন্যদিকে রাজকোষে ঘাটতি। রাজা দাবি করলেন, কর ছাগন রাজার ক্ষমতা। অনেক সময় গির্জার প্রতিনিধিরা পাপপুণ্যের ভয় দেখিয়ে অর্থ বা কর আদায় করতেন। ফলে রাজা জনগণের আনুগত্য লাভে বঞ্চিত হতেন। রাজা এখানে থেমে গেলেন না। মধ্যযুগে রাজারা অধিকাংশ সময় পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। এর জন্য দরকার হতো অর্থের। রাজা গির্জার বিপুল সম্পত্তির উপর কর চাপাতে মনস্থ করলেন। যাজকরা। বাধা দেয়ার জন্য এগিয়ে এলেন। তারা বললেন, গির্জার সম্পত্তি পরিচালনার নির্দেশ ভগবান প্রদত্ত। ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতার উপর রাজা হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এমনিভাবে কর স্থাপনের ক্ষেত্রে রাজা ও গির্জা বা পোপ আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করেন এবং উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

৫. পুরোহিতদের বিলাসবহুল জীবন: গির্জার সম্পত্তি বৃদ্ধির ফলে পুরোহিতদের নৈতিক অধঃপতন ঘটে। তাঁরা ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। গির্জা প্রধানদের বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সমাজে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং এর সর্বশেষ পর্যায় হিসেবে রাষ্ট্র তথা রাজা বা সম্রাটের সঙ্গে সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৬. গির্জার ক্ষমতা হ্রাস: চতুর্থ শতাব্দীতে সামন্ততন্ত্রের বিলোপ হওয়ার সাথে সাথে চার্চের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং সম্রাটের ভূমিকা বৃদ্ধি পায়। সর্বস্তরের জনগণ যাজক সম্প্রদায়ের আচার আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। এছাড়াও রাজনৈতিক তত্ত্বের বিকাশ লাভ করার ফলেও গির্জার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সমগ্র মধ্যযুগ ধরে গির্জা ও রাষ্ট্র তথা পোপ ও সম্রাট বা রাজার মধ্যে যন্য চলেছে। কখনো ধীরগতিতে আবার কখনো প্রবল বেগে এবং উভয়েই তাদের সুযোগমতো আধিপত্য বা প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে। কাজেই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, “মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তা গির্জা ও রাজশক্তির তথা গোপ ও সম্রাটের আধিপত্য বিস্তারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।”