অথবা, অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন আলোচনা কর।
অথবা, সেন্ট অগাস্টিনের রাজনৈতিক দর্শন মূল্যায়ন কর।
অথবা, রাষ্ট্রদর্শনে সেন্ট অগাস্টিনের অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, সেন্ট অগাস্টিন তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে কী কী বিষয়ে আলোচনা করেছেন? উল্লেখ কর।
উত্তর: ভূমিকা: মধ্যযুগের রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে সেন্ট অগাস্টিন অন্যতম। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার প্রসার ঘটার ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্ম বিশেষ ভূমিকা রাখে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের স্বীকৃতি এবং বহু দেববাদের প্রতি বিকার তিনি সমর্থন করেন নি। তিনি সেন্ট অ্যাড্রোজ এর নিকট দীক্ষা নেন। দীক্ষা গ্রহণের পর অগাস্টিন খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে প্রচুর পড়াশোনা করেন, বহু দেববাদীদের রোমান শক্তির পতন সম্পর্কে সমালোচনার জবাব দেয়ার জন্য তিনি তৈরি হতে থাকেন। এভাবে খ্রিস্টধর্মকে নতুন আলোকে বিচার করার জন্য অগাস্টিন নিজেকে গড়ে তোলেন। তিনি ‘The City of God’ গ্রন্থে যুক্তিসহকারে বহু দেববাদীদের আক্রমণ এবং সমালোচনার জবাব দেন এবং খ্রিস্টধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন।
সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন: সেন্ট অগাস্টিস মধ্যযুগে আলোকবর্তিকা হাতে সংকটাপন্ন মানুষকে পথ দেখিয়েছেন। তাঁর রচনা ও চিন্তনের মধ্যে তাঁর রাষ্ট্রদর্শন নিহিত। তাঁর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১. রোম সাম্রাজ্যের পতনের কারণ: সেন্ট অগাস্টিন তাঁর ‘The Civitate Dei’ গ্রন্থে রোম সাম্রাজ্যের পতনের একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেন। ৪১০ খ্রিস্টাব্দে এলানিক ও গোথ দস্যুদের আক্রমণে রোম সাম্রাজ্যের পতন হওয়ার পর দুর্বলচেতা প্যাগানপন্থি খ্রিস্টানগণ খ্রিস্টধর্মকে দোষী করতে শুরু করে। তাদের বক্তব্য ছিল খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার আগে রোম প্যাগানদের দেবীর অভিভাবত্বে ছিল তখন এ সাম্রাজ্যের কোন ক্ষতি হয় নি। বরং উত্তরোত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পয় রোমের পতন হওয়ায় তারা খ্রিস্টধর্মকেই পতনের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। সেন্ট অগাস্টিন প্যাগানদের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেছেন, “রোম সাম্রাজ্যের উন্নতি প্যাগানদের দেবদেবীর দান ছিল না। এর পতনের জন্য খ্রিস্টধর্ম দায়ী নয়, বরং বিধাতার ইচ্ছার মাধ্যমেই কোন রাষ্ট্রের উন্নতি ও পতন নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে দেবদেবীর কোন ভূমিকা নেই।”
২. দাসপ্রথা: গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের মতো অগাস্টিন দাসপ্রথাকে ন্যায়সঙ্গত বলে রায় দিয়েছিলেন। তিনি ক্রীতদাসদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির সাথে তুলনা করেছেন। এ প্রথা সংরক্ষণে যৌক্তিকতা প্রদান করেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের ন্যায় দাসপ্রথাও মানুষের পতনের অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রণতি। এ প্রথা মানুষের পাপ থেকে উৎসারিত। তাঁর মতে, দাসের ভাগ্য পাপের মাসুল বৈ কিছু নয়। দাসদের অবশ্য কর্তব্য হলো শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শন। অগাস্টিনের মতে, একবার পাপ করে কেউ কেউ ক্রীতদাস হয়েছে। আবার ক্রীতদাসের কর্তব্য পালন না করলে পুনরায় সে পাপ করবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, অগাস্টিন ক্রীতদাস ব্যবস্থাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায়সঙ্গত ও বিধিসম্মত বলে প্রতিপন্ন করেছেন।
৩. সম্পত্তি তত্ত্ব: সম্পতি তত্ত্ব সম্পর্কে সেন্ট অগাস্টিনের মতবাদ অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। তাঁর মতে, সম্পত্তি হস্যে বিধাতার দান। ঐশ্বরিক আইন ও মানবিক আইনের ফলে সম্পত্তির সৃষ্টি হয়েছে। সম্পত্তির সার্থকতা এর ভোগ ব্যবহারের মধ্যে। প্রত্যেকে তাদের অতিরিক্ত সম্পত্তি সকলের মঙ্গলার্থে ব্যবহার করবে। কেউ যদি সম্পত্তি ঠিকমতো ব্যবহার করতে না পারে তবে তার উপর তার কোন অধিকার থাকবে না। তবে সম্পত্তির ভোগ দখলের অধিকার প্রদান করবে রাষ্ট্র। মানুষ নিজে অধিকার তৈরি করতে পারবে না।
৪. মানব চরিত্র: অগাস্টিনের মতে, মানুষের জীবনের দু’টি অংশ আছে। একটি তার দেহ এবং অন্যটি তার আত্মা। আত্মা মানুষকে স্বর্গীয় সুখের সন্ধান ও সৎ পথে থাকার নির্দেশ দেন। কিন্তু দেহ পার্থিব সুখ সন্ধানে প্ররোচিত করে। এক শ্রেণির মানুষ আত্যার প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ তারা বিধাতার নির্দেশ পথে জীবনযাত্রা পরিচালনা করে। কিন্তু যারা দেহের প্রতিনিধিত্ব করে, দৈহিক সুখ লাভের বাসনা তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং তাদের উপর নেমে আসে পাপের বোঝা। শুরু হয় তাদের জীবনে দুঃখ ও যন্ত্রণার অধ্যায়।
৫. ধর্ম ও ন্যায়বিচার: প্লেটো যেমন ন্যায়ধর্মকে রাষ্ট্রের প্রাণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, অগাস্টিন ঠিক একইভাবে রাষ্ট্রকে ধর্ম ও ন্যায়বিচারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে, ধর্ম ও ন্যায়বিচার বিবর্জিত রাষ্ট্র একদল লুণ্ঠনকারী দ্বারা শাসিত।
৬. রষ্ট্রি ও সরকার: অগাস্টিনের মতে, রাষ্ট্র ও সরকার গড়ে উঠেছে মানুষের পাপ পড়ে। পাপ ছিল বলেই সরকারের প্রয়োজন অনুভূত হয়। পাপের পথে পা বাড়িয়েই মানুষকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসতে হয়। মানুষের খারাপ প্রবণতা রয়েছে, বলেই সরকারের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এর প্রতি মানুষের আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে।
৭. শাস্তি নীতি: অ্যাস্টিন প্রচলিত অর্থে শান্তিকে ব্যবহার করেন নি। সাধারণত যুদ্ধের বিপরীত বা অনুপস্থিতিকে শাস্তি বলা হয়। অগাস্টিন বিশ্বজনীন ঐক্যকে শাস্তি নীতিশ মূলভিত্তি হিসেবে দেখেছেন।
৮. গির্জার ভূমিকা: অগাস্টিনের মতে, রাষ্ট্রের একমাত্র সংস্থা হলো চার্চ বা গির্জা। তাঁর মতে, গির্জা হচ্ছে পার্থিব জগতের একমাত্র সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। গির্জা শুধু যে দৈবরাষ্ট্রের একটি অংশ তা নয়, এ রাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য গির্জাই হচ্ছে প্রধানতম সিংহদ্বার। তাঁর মতে, বিধাতার রাষ্ট্রের শাসক স্বয়ং স্রষ্টা এবং গির্জা হচ্ছে এর প্রকৃত প্রতিনিধি। গির্জার ব্যর্থতার অর্থ হলো রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। তিনি মনে করেন, গির্জার বা চার্চের সাহায্যেই রাষ্ট্র তার নাগরিকদের শাশ্বত মুক্তির পথে পরিচালিত করতে পারে।
৯. ঐশ্বরিক সতবাদ: অগাস্টিন তাঁর ‘The City of God’ গ্রন্থে রাষ্ট্রের জন্ম, বৃদ্ধি ও ধ্বংসের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল বলে উল্লেখ করেন। বস্তুত তিনি রাষ্ট্রের ঐশ্বরিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শন মধ্যযুগে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি বিশ্বের সকল খ্রিস্টানদেরকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে প্রটেস্ট্যান্ট এবং রোমের ক্যাথলিক লেখকগণ সেন্ট অগাস্টিনের আদর্শে প্রভাবান্বিত হয়ে অনেক পুস্তক রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থটিতে রাজনীতির সকল বিষয়েরই উল্লেখ ছিল। সর্বাত্রাকবাদী এবং গণতান্ত্রিক উভয় রাষ্ট্রদর্শন তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। কাজেই বলা যায় মধ্যযুগের চিন্তানায়কদের মধ্যে সেন্ট অগাস্টিনের স্থান বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ।