অথবা, সেন্ট অগাস্টিলের ‘De civitate Dei’ এ গ্রন্থের মূল বক্তব্যসমূহ বর্ণনা কর। অথবা, “The City of God” গ্রন্থের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।” উক্তিটি পর্যালোচনা কর। অথবা, “The City of God” গ্রন্থে কীভাবে সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রটিভার প্রতিফলন ঘটেছে? আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: সুদীর্ঘ তেরো বছর পরিশ্রম করে সেন্ট অগাস্টিন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘De Civitate Dei’ বা The City of God’ গ্রন্থটি রচনা করে। Prof Gettell বলেছেন, পঞ্চম শতাব্দীতে এটি একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী এন্থ ছিল। বহু দেববাদীরা যে খ্রিস্টধর্মের সমালোচনা করত অগাস্টিন (Augustine) তাঁর প্রতিবাদে এ গ্রন্থ রচনা করেন। Prof. Sabine বলেছেন, “His (Augustine) great book The City of God was written to defend Christianity against the pagan charge that was responsible for the decline of Roman power.” (History of Political Theory, P-189)। বহু দেববাদকে সমালোচনা করা বা এর অসারতা প্রতিষ্ঠিত করাই অগাস্টিনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। The City of God’ নামক বিশাল গ্রন্থে তিনি গঠনমূলক প্রস্তাব দিয়ে গেছেন। তিনি মনে করতেন, স্বর্গীয় শহরে সবসময় সততা, নিষ্ঠা ও সদগুণ বিরাজ করে। সুখশান্তি অর্জন করতে হলে মানুষকে ধর্মপ্রাণ ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।
‘দি সিটি অব গড’ (The City of God) এর তাৎপর্য: সেন্ট অগাস্টিন এর The City of God’ গ্রন্থের মূল্যায়ন করতে গিয়ে Prof. Gettell বলেছেন, “The work of Augustine gave to the church at a critical period of history a crystallized body of thought and put into definite statements the ideal which gave it distinctive existence and self-conscious purpose.” রোমান সাম্রাজ্য ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় ঐক্য ও সংহতিতে চরম সংকট দেখা দেয়। বহিরাগত জাতিগুলো এসে রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির এবং খ্রিস্টধর্মের উপর চরম আঘাত হানে। বহু দেববাদের উত্থান ও তীব্র প্রভাব ও খ্রিস্টধর্মের প্রভাব হ্রাস লক্ষ্য করে অগাস্টিন তাঁর এ বিখ্যাত গ্রন্থ’ The City of God’ লেখেন। তাই এ গ্রন্থের তাৎপর্য অপরিসীম। নিম্নে এ গ্রন্থের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হলো:
১. ‘দি সিটি অব গড’ ঐক্যের প্রতীক: আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে অগাস্টিনের The City of God’ একটি তাৎপর্যহীন গ্রন্থ, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। পঞ্চম শতাব্দীতে যেসব গ্রন্থ লেখা হয়েছিল তাদের মধ্যে The City of God বিশেষ মর্যাদা ও তাৎপর্যের অধিকারী ছিল। গির্জা ও বহু দেববাদী রাষ্ট্রের মধ্যে যে সংঘর্ষ দেখা দিয়েছিল তার অবসানের সূচনা করে ‘দি সিটি অব গড’। রাষ্ট্রকে গির্জার অধীনে এনে দেশের সর্বত্র খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য স্থাপনের কথা অগাস্টিন সর্বপ্রথম উচ্চোরণ করেন। মানুষ ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন ও সৎ না হলে এবং ন্যায়বিচারকে রাষ্ট্রের ভিত্তি না করলে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এককথায় বলা যেতে পারে, ‘দি সিটি অব গড’ রাষ্ট্রের সার্বিক ঐক্য ও সংহতির কথাই বলে।
২. ‘দি সিটি অব গড’ সৎ এবং অসৎ এর প্রতীক: ‘দি সিটি অব গড’ গ্রন্থে যে স্বর্গীয় ও পার্থিব রাজ্যের বা শহরের উল্লেখ আছে তাকে আক্ষরিক অর্থে বিচার করলে ভুল হবে বলে পণ্ডিতগণ ধারণা করেন। হার্মন বলেছেন, এ দু’টি শহর বস্তুত স্বর্গ বা মর্ত্যের নয় অথবা গির্জা ও রাষ্ট্রের প্রতীক নয়। প্রকৃতপক্ষে, সৎ ও অসৎ এর প্রতীক হলো স্বর্গীয় ও পার্থিব শহর। অনন্তকাল ধরে শুভ ও অশুভের মধ্যে সংগ্রাম বা দ্বন্দ্ব চলে আসছে এবং আজও সে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে নি। দু’টি শহর বলতে অগাস্টিন সৃষ্টিকর্তা ও শয়তানের কথা বলতে চেয়েছেন। বহু দেববাদীদের আক্রমণে ও ক্রমবর্ধমান প্রভাবে খ্রিস্টধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং অগাস্টিন নিজে ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান। তিনি খুব কষ্ট অনুভব করেন। বহু দেববাদীদের প্রভাব ও বর্বর জাতিসমূহের আক্রমণ থেকে রোমান সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য স্বর্গীয় ও পার্থিব শহরের উল্লেখ করেছেন। স্বর্গীয় শহর সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও যাবতীয় শুভ’র প্রতীক। এদের বিপরীতগুলো পার্থিব শহরের প্রতীক। তাঁর মনে এ প্রত্যয় জন্মেছিল যে, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে সংগ্রামের ফলে শেষপর্যন্ত ন্যায় জয়লাভ করবেই। কেউ তা ঠেকাতে পারবে না। একমাত্র সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা মানুষের মুক্তি আনতে পারে। মানুষ যদি খ্রিস্টধর্মের প্রতি আসক্ত হয় তাহলে তা সম্ভব। এমনকি রাষ্ট্রকেও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হতে হবে বলে তিনি ঘোষণা করেছেন।
৩. গির্জা বনাম রাষ্ট্র: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের অনুকরণে অগাস্টিন একটা ধর্মভিত্তিক সুন্দর রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। এ রাষ্ট্রের নাগরিকরা হবে ধর্মপ্রাণ, ন্যায়বান, নীতিবান এবং সকলে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকে রাষ্ট্রের সঠিক বিকাশ সাধনে নিজেদের শ্রমশক্তি নিয়োজিত করবে। তিনি কখনও চান নি যে, রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে গির্জার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হোক, তবে গির্জা রাষ্ট্রের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নিয়ন্ত্রক হবে। অন্যান্য ব্যাপারে রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। ‘City of God’ এ তিনি নানাভাবে একথা প্রকাশ করে গেছেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কাজ ও এক্তিয়ার আছে এবং সে এক্তিয়ারে সে পুরোপুরি স্বাধীন। অতএব অগাস্টিনের হাতে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ উপেক্ষিত এমন কথা বলা যায় না। বরং তিনি উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন।
- ৪. রাষ্ট্রের কাজ শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপন করা: ‘The City of God’ গ্রন্থ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে হার্মন বলেছেন,
৩১১ অগাস্টিন মনে করতেন যে, রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। রাষ্ট্র ও জনগণ খ্রিস্টধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। পার্থিব রাষ্ট্রের জনগণ বস্তুগত সুখ লাভের জন্য শান্তি ও শৃঙ্খলা চায়। কিন্তু অপার্থিব শহরের জনগণ শান্তি চায় ভগবানের সান্নিধ্য লাভের জন্য। বহু দেববাদীদের প্রভাবে ও বর্বর জাতিসমূহের আক্রমণে সমাজে নৈরাজ্য দেখা দিচ্ছিল বলে অগাস্টিন বলেছেন, জনগণকে ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন হতে হবে। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে ধর্ম। এর পরে রাষ্ট্র শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করবে। ধর্মবোধ অপসারিত হলে মানুষ পাপাচারে নিমগ্ন হয়, বিশৃঙ্খল আচরণ করে। অগাস্টিন পরোক্ষভাবে বলতে চেয়েছেন যে, জনগণের মধ্যে ধর্মবোধ জাগিয়ে তোলাও রাষ্ট্রের কাজ।
৫. দুই যুগের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা: Ebenstein বলতে চেয়েছেন যে, অগাস্টিন এসেছিলেন দুই যুগের সন্ধিক্ষণে। প্রাচীন যুগ ছিল প্লেটো, এরিস্টটল, সিসেরো ও নির্বিকারবাদী দার্শনিকদের নিয়ে। এরা ভাববাদ, প্রাকৃত আইন ইত্যাদিকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। খ্রিস্টধর্ম বা অন্য কোন ধর্মের প্রভাব এদের রাষ্ট্রচিন্তা বা দর্শনচিন্তার উপর স্পষ্ট প্রভাব পড়ে নি। অগাস্টিন এসে খ্রিস্টধর্মের জয়গান শুরু করে দিলেন। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে আদর্শ ধারণাটিকে সরিয়ে দিয়ে ধর্ম কথাটা বসিয়ে দিলেন। অগাস্টিন এর রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াল ধর্মীয় বা খ্রিস্টীয় বা গির্জা রাষ্ট্র। আদর্শ রাষ্ট্রের যেসব বৈশিষ্ট্য বা গুণ ছিল তাদের অনেকগুলোকে তিনি খ্রিস্টীয় রাষ্ট্রে স্থাপন করে দিলেন।
৬. সর্বাত্মকবাদী ও গণতন্ত্র অগাস্টিনের ‘The City of God’ গ্রন্থটি সর্বাত্মকবাদ এবং একইসঙ্গে গণতন্ত্রের প্রতীক। M. B. Foster এর মতে, “অগাস্টিনের উচ্চতর শক্তি নীতি বর্জন ও গ্রহণের উপর যথাক্রমে বর্তমান কালের সর্বাত্মকবাদী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শন প্রতিষ্ঠিত।” সর্বাত্মকবাদের মূল কথা হলো রাষ্ট্রের উপর আর কোন উচ্চতর প্রতিষ্ঠান নেই এবং মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে। অন্যদিকে গণতন্ত্রের মূল কথা হলো রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব একান্তভাবে পার্থিব পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ এবং রাষ্ট্র নাগরিকের সর্বোচ্চ অনুগত্যের দ্বারা পরিচালিত। অর্থাৎ তাঁর ‘The City of God’ সর্বাত্যকবাদ ও গণতন্ত্রের প্রতীক।
৭. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: স্বর্গীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে ন্যায়বিচার। অগাস্টিন বলেছেন যে, ন্যায়বিচার ছাড়া আইনকে স্বেচ্ছাচারী নির্দেশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। প্রকৃত ন্যায়বিচার যেখানে নেই, সেখানে আইনও থাকতে পারে না। অগাস্টিন মনে করতেন, যে রাষ্ট্র ন্যায়বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় সে রাষ্ট্র কখনো স্থায়ী হতে পারে না। আর ন্যায়বিচার হলো প্রত্যেককে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দেয়ার নাম। তিনি আরও বলেছেন, যখন মানুষ আত্মার দ্বারা শাসিত হয় কেবল তখনই ন্যায়বিচার অর্জিত হতে পারে।
হলো: অগাস্টিনের ‘The City of God’ গ্রন্থের মূল্যায়ন: নিম্নে অগাস্টিনের The City of God গ্রন্থের মূল্যায়ন করা
১. অগাস্টিনের The City of God গ্রন্থটি অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচিত। বিশেষ করে রাষ্ট্রতত্ত্বের তুলনায় তিনি ধর্মকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। ইবেনস্টাইন বলেন, The City of God কে একটি রাজনৈতিক গ্রন্থে মর্যাদা দেয়া সমীচীন নয়।
২. The City of God মূল্যায়ন করতে গিয়ে গেটেল বলেন, অগাস্টাইন এর The City of God ইতিহাসের এক সংকটকালে লেখা হয়েছিল। কতকগুলো স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট চিন্তার হদিস আমরা এ গ্রন্থে পাই। তিনি আদর্শ সম্পর্কে যে সমস্ত কথা বলেছেন, পরবর্তীকালে সেগুলো অনেকে অনুসরণ করেন।
৩. তাঁর The City of God গ্রন্থটি মূলত তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব প্রচারের তুলনায় খ্রিস্টধর্মকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে অবতীর্ণ করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে যেসব গ্রন্থ রচিত হয়েছিল সেন্ট অগাস্টিনের। The City of God’ তাদের মধ্যে অন্যতম। বহু দেববাদীরা যে খ্রিস্টধর্মের সমালোচনা করতো অগাস্টিন তাঁর প্রতিবাদে এ গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, সুখশান্তি অর্জন করতে হলে মানুষকে ধর্মপ্রাণ ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। তাই The City of God’ এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। ‘De civitate Dei’ এ গ্রন্থের মূল বক্তব্যসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, “The City of God” গ্রন্থের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।” উক্তিটি পর্যালোচনা কর।
অথবা, “The City of God” গ্রন্থে কীভাবে সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রটিভার প্রতিফলন ঘটেছে? আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: সুদীর্ঘ তেরো বছর পরিশ্রম করে সেন্ট অগাস্টিন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘De Civitate Dei’ বা The City of God’ গ্রন্থটি রচনা করে। Prof Gettell বলেছেন, পঞ্চম শতাব্দীতে এটি একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী এন্থ ছিল। বহু দেববাদীরা যে খ্রিস্টধর্মের সমালোচনা করত অগাস্টিন (Augustine) তাঁর প্রতিবাদে এ গ্রন্থ রচনা করেন। Prof. Sabine বলেছেন, “His (Augustine) great book The City of God was written to defend Christianity against the pagan charge that was responsible for the decline of Roman power.” (History of Political Theory, P-189)। বহু দেববাদকে সমালোচনা করা বা এর অসারতা প্রতিষ্ঠিত করাই অগাস্টিনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না। The City of God’ নামক বিশাল গ্রন্থে তিনি গঠনমূলক প্রস্তাব দিয়ে গেছেন। তিনি মনে করতেন, স্বর্গীয় শহরে সবসময় সততা, নিষ্ঠা ও সদগুণ বিরাজ করে। সুখশান্তি অর্জন করতে হলে মানুষকে ধর্মপ্রাণ ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে।
‘দি সিটি অব গড’ (The City of God) এর তাৎপর্য: সেন্ট অগাস্টিন এর The City of God’ গ্রন্থের মূল্যায়ন করতে গিয়ে Prof. Gettell বলেছেন, “The work of Augustine gave to the church at a critical period of history a crystallized body of thought and put into definite statements the ideal which gave it distinctive existence and self-conscious purpose.” রোমান সাম্রাজ্য ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর জাতীয় ঐক্য ও সংহতিতে চরম সংকট দেখা দেয়। বহিরাগত জাতিগুলো এসে রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির এবং খ্রিস্টধর্মের উপর চরম আঘাত হানে। বহু দেববাদের উত্থান ও তীব্র প্রভাব ও খ্রিস্টধর্মের প্রভাব হ্রাস লক্ষ্য করে অগাস্টিন তাঁর এ বিখ্যাত গ্রন্থ’ The City of God’ লেখেন। তাই এ গ্রন্থের তাৎপর্য অপরিসীম। নিম্নে এ গ্রন্থের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হলো:
১. ‘দি সিটি অব গড’ ঐক্যের প্রতীক: আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে অগাস্টিনের The City of God’ একটি তাৎপর্যহীন গ্রন্থ, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। পঞ্চম শতাব্দীতে যেসব গ্রন্থ লেখা হয়েছিল তাদের মধ্যে The City of God বিশেষ মর্যাদা ও তাৎপর্যের অধিকারী ছিল। গির্জা ও বহু দেববাদী রাষ্ট্রের মধ্যে যে সংঘর্ষ দেখা দিয়েছিল তার অবসানের সূচনা করে ‘দি সিটি অব গড’। রাষ্ট্রকে গির্জার অধীনে এনে দেশের সর্বত্র খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য স্থাপনের কথা অগাস্টিন সর্বপ্রথম উচ্চোরণ করেন। মানুষ ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন ও সৎ না হলে এবং ন্যায়বিচারকে রাষ্ট্রের ভিত্তি না করলে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এককথায় বলা যেতে পারে, ‘দি সিটি অব গড’ রাষ্ট্রের সার্বিক ঐক্য ও সংহতির কথাই বলে।
২. ‘দি সিটি অব গড’ সৎ এবং অসৎ এর প্রতীক: ‘দি সিটি অব গড’ গ্রন্থে যে স্বর্গীয় ও পার্থিব রাজ্যের বা শহরের উল্লেখ আছে তাকে আক্ষরিক অর্থে বিচার করলে ভুল হবে বলে পণ্ডিতগণ ধারণা করেন। হার্মন বলেছেন, এ দু’টি শহর বস্তুত স্বর্গ বা মর্ত্যের নয় অথবা গির্জা ও রাষ্ট্রের প্রতীক নয়। প্রকৃতপক্ষে, সৎ ও অসৎ এর প্রতীক হলো স্বর্গীয় ও পার্থিব শহর। অনন্তকাল ধরে শুভ ও অশুভের মধ্যে সংগ্রাম বা দ্বন্দ্ব চলে আসছে এবং আজও সে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে নি। দু’টি শহর বলতে অগাস্টিন সৃষ্টিকর্তা ও শয়তানের কথা বলতে চেয়েছেন। বহু দেববাদীদের আক্রমণে ও ক্রমবর্ধমান প্রভাবে খ্রিস্টধর্ম কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং অগাস্টিন নিজে ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান। তিনি খুব কষ্ট অনুভব করেন। বহু দেববাদীদের প্রভাব ও বর্বর জাতিসমূহের আক্রমণ থেকে রোমান সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য স্বর্গীয় ও পার্থিব শহরের উল্লেখ করেছেন। স্বর্গীয় শহর সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও যাবতীয় শুভ’র প্রতীক। এদের বিপরীতগুলো পার্থিব শহরের প্রতীক। তাঁর মনে এ প্রত্যয় জন্মেছিল যে, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে সংগ্রামের ফলে শেষপর্যন্ত ন্যায় জয়লাভ করবেই। কেউ তা ঠেকাতে পারবে না। একমাত্র সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা মানুষের মুক্তি আনতে পারে। মানুষ যদি খ্রিস্টধর্মের প্রতি আসক্ত হয় তাহলে তা সম্ভব। এমনকি রাষ্ট্রকেও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হতে হবে বলে তিনি ঘোষণা করেছেন।
৩. গির্জা বনাম রাষ্ট্র: প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের অনুকরণে অগাস্টিন একটা ধর্মভিত্তিক সুন্দর রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন। এ রাষ্ট্রের নাগরিকরা হবে ধর্মপ্রাণ, ন্যায়বান, নীতিবান এবং সকলে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ থেকে রাষ্ট্রের সঠিক বিকাশ সাধনে নিজেদের শ্রমশক্তি নিয়োজিত করবে। তিনি কখনও চান নি যে, রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে গির্জার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হোক, তবে গির্জা রাষ্ট্রের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নিয়ন্ত্রক হবে। অন্যান্য ব্যাপারে রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। ‘City of God’ এ তিনি নানাভাবে একথা প্রকাশ করে গেছেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কাজ ও এক্তিয়ার আছে এবং সে এক্তিয়ারে সে পুরোপুরি স্বাধীন। অতএব অগাস্টিনের হাতে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ উপেক্ষিত এমন কথা বলা যায় না। বরং তিনি উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন।
৪. রাষ্ট্রের কাজ শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপন করা: ‘The City of God’ গ্রন্থ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে হার্মন বলেছেন, অগাস্টিন মনে করতেন যে, রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। রাষ্ট্র ও জনগণ খ্রিস্টধর্ম থেকে বিচ্যুত হলে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। পার্থিব রাষ্ট্রের জনগণ বস্তুগত সুখ লাভের জন্য শান্তি ও শৃঙ্খলা চায়। কিন্তু অপার্থিব শহরের জনগণ শান্তি চায় ভগবানের সান্নিধ্য লাভের জন্য। বহু দেববাদীদের প্রভাবে ও বর্বর জাতিসমূহের আক্রমণে সমাজে নৈরাজ্য দেখা দিচ্ছিল বলে অগাস্টিন বলেছেন, জনগণকে ধর্মীয় মনোভাবাপন্ন হতে হবে। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে ধর্ম। এর পরে রাষ্ট্র শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করবে। ধর্মবোধ অপসারিত হলে মানুষ পাপাচারে নিমগ্ন হয়, বিশৃঙ্খল আচরণ করে। অগাস্টিন পরোক্ষভাবে বলতে চেয়েছেন যে, জনগণের মধ্যে ধর্মবোধ জাগিয়ে তোলাও রাষ্ট্রের কাজ।
৫. দুই যুগের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা: Ebenstein বলতে চেয়েছেন যে, অগাস্টিন এসেছিলেন দুই যুগের সন্ধিক্ষণে। প্রাচীন যুগ ছিল প্লেটো, এরিস্টটল, সিসেরো ও নির্বিকারবাদী দার্শনিকদের নিয়ে। এরা ভাববাদ, প্রাকৃত আইন ইত্যাদিকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। খ্রিস্টধর্ম বা অন্য কোন ধর্মের প্রভাব এদের রাষ্ট্রচিন্তা বা দর্শনচিন্তার উপর স্পষ্ট প্রভাব পড়ে নি। অগাস্টিন এসে খ্রিস্টধর্মের জয়গান শুরু করে দিলেন। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র থেকে আদর্শ ধারণাটিকে সরিয়ে দিয়ে ধর্ম কথাটা বসিয়ে দিলেন। অগাস্টিন এর রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াল ধর্মীয় বা খ্রিস্টীয় বা গির্জা রাষ্ট্র। আদর্শ রাষ্ট্রের যেসব বৈশিষ্ট্য বা গুণ ছিল তাদের অনেকগুলোকে তিনি খ্রিস্টীয় রাষ্ট্রে স্থাপন করে দিলেন।
৬. সর্বাত্মকবাদী ও গণতন্ত্র: অগাস্টিনের ‘The City of God’ গ্রন্থটি সর্বাত্মকবাদ এবং একইসঙ্গে গণতন্ত্রের প্রতীক। M. B. Foster এর মতে, “অগাস্টিনের উচ্চতর শক্তি নীতি বর্জন ও গ্রহণের উপর যথাক্রমে বর্তমান কালের সর্বাত্মকবাদী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শন প্রতিষ্ঠিত।” সর্বাত্মকবাদের মূল কথা হলো রাষ্ট্রের উপর আর কোন উচ্চতর প্রতিষ্ঠান নেই এবং মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে। অন্যদিকে গণতন্ত্রের মূল কথা হলো রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব একান্তভাবে পার্থিব পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ এবং রাষ্ট্র নাগরিকের সর্বোচ্চ অনুগত্যের দ্বারা পরিচালিত। অর্থাৎ তাঁর ‘The City of God’ সর্বাত্যকবাদ ও গণতন্ত্রের প্রতীক।
৭. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: স্বর্গীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে ন্যায়বিচার। অগাস্টিন বলেছেন যে, ন্যায়বিচার ছাড়া আইনকে স্বেচ্ছাচারী নির্দেশ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। প্রকৃত ন্যায়বিচার যেখানে নেই, সেখানে আইনও থাকতে পারে না। অগাস্টিন মনে করতেন, যে রাষ্ট্র ন্যায়বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় সে রাষ্ট্র কখনো স্থায়ী হতে পারে না। আর ন্যায়বিচার হলো প্রত্যেককে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দেয়ার নাম। তিনি আরও বলেছেন, যখন মানুষ আত্মার দ্বারা শাসিত হয় কেবল তখনই ন্যায়বিচার অর্জিত হতে পারে।
হলো: অগাস্টিনের ‘The City of God’ গ্রন্থের মূল্যায়ন: নিম্নে অগাস্টিনের The City of God গ্রন্থের মূল্যায়ন করা
১. অগাস্টিনের The City of God গ্রন্থটি অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচিত। বিশেষ করে রাষ্ট্রতত্ত্বের তুলনায় তিনি ধর্মকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। ইবেনস্টাইন বলেন, The City of God কে একটি রাজনৈতিক গ্রন্থে মর্যাদা দেয়া সমীচীন নয়।
২. The City of God মূল্যায়ন করতে গিয়ে গেটেল বলেন, অগাস্টাইন এর The City of God ইতিহাসের এক সংকটকালে লেখা হয়েছিল। কতকগুলো স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট চিন্তার হদিস আমরা এ গ্রন্থে পাই। তিনি আদর্শ সম্পর্কে যে সমস্ত কথা বলেছেন, পরবর্তীকালে সেগুলো অনেকে অনুসরণ করেন।
৩. তাঁর The City of God গ্রন্থটি মূলত তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব প্রচারের তুলনায় খ্রিস্টধর্মকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে অবতীর্ণ করে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে যেসব গ্রন্থ রচিত হয়েছিল সেন্ট অগাস্টিনের। The City of God’ তাদের মধ্যে অন্যতম। বহু দেববাদীরা যে খ্রিস্টধর্মের সমালোচনা করতো অগাস্টিন তাঁর প্রতিবাদে এ গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, সুখশান্তি অর্জন করতে হলে মানুষকে ধর্মপ্রাণ ও ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। তাই The City of God’ এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম।