অথবা, “সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শনের মূল উদ্দেশ্য ছিল গির্জাকে শক্তিশালী রূপে প্রতিষ্ঠিত করা- আলোচনা কর।
অথবা, “সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল? এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তিনি কিভাবে কাজ করেছেন? বর্ণনা কর।
উত্তর: ভূমিকা: রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে সেন্ট অগাস্টিন একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। মধ্যযুগের প্লেটো নামে খ্যাত – সেন্ট অগাস্টিন গ্রিক, রোমান ও খ্রিস্টীয় সভ্যতার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এ পৃথিবীর মানুষের জন্য তাঁর অভয় বাণী প্রচার করে গেছেন। বিশ্ব ইতিহাসের মহা সংকটময় মুহূর্তে জীবনের পথ পরিক্রমা শুরু করে তিনি রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে যে জ্ঞানগর্ভআলোচনা করে গেছেন তা পরবর্তী দার্শনিকদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘De Civitate Deï’ or, ‘City of God’। তিনি এ গ্রন্থে প্যাগানদের ধর্মের সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হন নি, বরং কিভাবে রাষ্ট্র গঠন করা হবে সে সম্পর্কে পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছেন। আর রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে গিয়েই তিনি গির্জাকে অধিক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
সেন্ট অগাস্টিনের রাজনৈতিক দর্শনের প্রধান লক্ষ্য ছিল গির্জাকে শক্তিশালী করা: মধ্যযুগের রাষ্ট্রদর্শন ছিল প্রধানত ধর্ম ও গির্জাকেন্দ্রিক। তাই সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্রদর্শনে সমসাময়িক সময়ের একটা রাজাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে রাষ্ট্রের গঠন, প্রকৃতি ও ক্ষমতা সম্পর্কে যে আলোচনা করেছেন সেখানে তিনি মূলত সকল ক্ষমতা গির্জার উপরই ন্যস্ত করেছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, গির্জা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রকৃত প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা গির্জার নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হবে। সেন্ট অগাস্টিনের এরূপ রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে ডব্লিউ, এ. জানিং, মন্তব্য করেন, “মধ্যযুগ ছিল মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস ও গির্জাকে প্রতিষ্ঠিত করার যুগ।” সেন্ট অগাস্টিন যেসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গির্জাকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে তোলেন সেগুলো নিম্নরূপ:
১. গির্জা সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান: অগাস্টিনের মতে, রাষ্ট্রের একমাত্র সংস্থা হল চার্চ বা গির্জা। তাঁর মতে, গির্জা হচ্ছে পার্থিব জগতের একমাত্র সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। গির্জা শুধুই যে দৈব রাষ্ট্রের একটি অংশ তা নয়, এ রাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য গির্জাই হচ্ছে প্রধানতম সিংহদ্বার। তাঁর মতে, বিধাতার রাষ্ট্রের শাসক স্বয়ং স্রষ্টা এবং গির্জা হচ্ছে এর প্রকৃত প্রতিনিধি। গির্জার ব্যর্থতার অর্থ হল রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। তিনি মনে করেন, গির্জা বা চার্চের সাহায্যেই রাষ্ট্র তার নাগরিকদের শাশ্বত মুক্তির পথে পরিচালিত করতে পারে।
২. গির্জাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা: পঞ্চম শতকে রোমের দুর্ভেদ্য সীমান্ত ব্যূহ ভেঙে পড়লে ধর্মহীন ব্যক্তিরা অভিযোগ করে যে, খ্রিস্টধর্ম মান্য করার কারণেই রোমের পতন ঘটেছে। এ সময় অগাস্টিন এ অভিযোগের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে জনগণকে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, খ্রিস্টধর্ম মানার জন্য নয়, বরং ধর্ম না মানার ফলেই রোমের এ পরিণতি ঘটেছে। তাই এ অবস্থা হতে মুক্তির জন্য গির্জাকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন এবং গির্জাকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হওয়া উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
৩. গির্জা মানব মুক্তির পথ নির্দেশক: অগাস্টিনের মতে, একমাত্র পাপমুক্তির মাধ্যমেই মানুষ স্বর্গীয় আনন্দ ও সুখ ভোগ করতে পারে। আর এক্ষেত্রে গির্জাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে পাপমুক্তি সম্ভব। এছাড়া তিনি গির্জাকে একটি সামাজিক মিলন সংঘ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। এভাবে গির্জাকে মানব মুক্তির পথ নির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি গির্জার ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন।
৪. সর্বোচ্চ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান: অগাস্টিন মনে করেন, ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার নেই, বরং প্রয়োজনে রাষ্ট্র ধর্মীয় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গির্জার নীতি অনুসরণ করবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি অহেতুক হস্তক্ষেপ করে তবে জনগণ রাষ্ট্রীয় আদেশ অমান্য করতে পারবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। এভাবে তিনি ধর্মীয় ব্যাপারে গির্জাকেই সর্বেসর্বা বলেছেন।
৫. গির্জা বাস্তব প্রতিষ্ঠান: সেন্ট অগাস্টিন মতামত প্রকাশ করেন যে, গির্জা একটি বাস্তবধর্মী প্রতিষ্ঠান, তাই এ প্রতিষ্ঠানটি শক্তিশালী করা উচিত। গির্জা মানুষকে পাপ কাজ হতে বিরত রাখে এবং মানুষের কল্যাণের পক্ষে কাজ করে থাকে। এ প্রতিষ্ঠান বাস্তবতার আলোকেই সকল সমস্যার সমাধান করে। তাই এ প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতা অধিক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
৬. রাষ্ট্র ও গির্জার সম্পর্ক: অগাস্টিনের মতে, রাষ্ট্র গির্জার সাহায্য নিয়েই দেশ পরিচালনা করবে এবং জনগণের শাশ্বত মুক্তির পথ দেখাবে। তিনি তাঁর ‘City of God’ গ্রন্থে কিভাবে গির্জাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় সে সম্পর্কে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, গির্জার প্রতি রাষ্ট্রের আনুগত্য খ্রিস্টধর্মের প্রতি বিশ্বাসের প্রচলিত প্রথা এবং এতে ধর্মযাজকদের উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা লাভের অধিকারকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, গির্জা ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক আলোচনায় তিনি গির্জাকে অধিক শক্তিশালী করার পক্ষে ছিলেন।
৭. গির্জা স্বর্গরাজ্যের প্রতীক ও প্রবেশদ্বার: সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রেম, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও মহত্ত্বের সমন্বয়ই হলো স্বর্গরাজ্যের বৈশিষ্ট্য। এ রাজ্য চিরন্তন, শাশ্বত এবং নিত্য। অগাস্টিনের মতে, গির্জা হচ্ছে এ স্বর্গরাজ্যের পার্থিবরূপ। তাই গির্জার মাধ্যমেই মানুষ পেতে পারে মুক্তির আনন্দ ও স্বর্গীয় সুখের হাতছানি। অর্থাৎ তিনি গীর্জাকে স্বর্গরাজ্যের প্রতীক ও প্রবেশদ্বার হিসেবে অভিহিত করে মূলত গির্জার শক্তিকে বৃদ্ধি করার পক্ষে ছিলেন।
৮. পার্থিব রাষ্ট্র: অগাস্টিনের মতে, পার্থিব রাষ্ট্র হচ্ছে স্কুল এবং দৈহিক গুণাবলির প্রতীক। এরূপ রাষ্ট্র অহংকার, পাণ ও স্বার্থপরতার উপর প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর বুকে যতদিন পাপ থাকবে ততদিন পার্থিব রাষ্ট্র গড়ে উঠে জাগতিক প্রয়োজনে টিকে থাকে মানুষের লোভ ও মোহের কারণে। ফলে রাষ্ট্রের লোকেরা প্রকৃত সুখ হতে বঞ্চিত হয়। তাই রাষ্ট্রে সুখশান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য গির্জাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
৯. বিধাতার রাষ্ট্র: অগাস্টিন মনে করেন, বিধাতার রাষ্ট্র হলো অনন্ত আশীর্বাদপুষ্ট এক আলোর রাজ্য, যা চিরভাস্বর এবং জোতির্ময়। বিধাতার রাষ্ট্র গড়ে উঠে খোদা প্রেমের ফলে, যে প্রেম জাগতিক স্নেহ ভালোবাসাকে হীন ও তুচ্ছ করে প্রত্যাখ্যান করে। স্রষ্টার প্রতি প্রেমই হলো এরূপ রাষ্ট্রের মানুষের বৈশিষ্ট্য। ফলে এ রাষ্ট্রে মানুষ স্থায়ী সুখ ভোগ করতে পারে।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সেন্ট অগাস্টিনের রাষ্ট্র দর্শন মধ্যযুগে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মধ্যযুগের অরাজনৈতিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাধারায় গোড়াপত্তন করে তিনি যে গির্জাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তা পরবর্তী দার্শনিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আর গির্জাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে বিভিন্ন তত্ত্বের বা যুক্তির অবতারণা করেন। তাঁর প্রদত্ত রাষ্ট্রদর্শন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি যেসব যুক্তি দিয়েছেন তার প্রধান উদ্দেশ্যই গির্জাকে শক্তিশালী করা। তাই অনেকেই তাঁর রাষ্ট্রদর্শনকে গীর্জকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বলে অভিমত দিয়েছেন।