অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সেন্ট টমাস একুইনাসের মতবাদ পর্যালোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রদর্শনে সেন্ট টমাস একুইনাসের অবদান মূল্যায়ন কর।
অথবা, সেন্টটমাস একুইনাস রাষ্ট্রদর্শনে কিভাবে অবদান রেখেছেন আলোচনা কর।
অথবা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সেন্ট টমাস একুইনাসের মতবাদকে তুমি কিভাবে মূল্যায়ন করবে? ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: মধ্যযুগের রাষ্ট্র যখন এক চরম স্থবির ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় কাটছিল, যেখানে রাজতন্ত্র, রাজনীতি ও পোপতন্ত্র পরস্পর পরস্পরের সম্মুখে সংঘর্ষে উপনীত ছিল, সে আগ্নেয়গিরির লাভামুখে বসে যিনি উপরিউক্ত তিনের সুন্দর সমন্বয় গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিবেদিত ছিলেন তিনি হলেন টমাস একুইনাস। তিনি সিসিলি ও ক্যাম্পানিয়া রাজ্যের উপকন্ঠে রোজ়াসিকায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যযুগের উত্তম লেখকরূপে একুইনাস যথেষ্ট সুখ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে ‘Summa Theologica’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ গ্রন্থখানার মধ্যে একুইনাসের রাষ্ট্রতত্ত্বসহ সামগ্রিক দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়।
একুইনাসের রাষ্ট্রদর্শন ও রাজনৈতিক অবদান: একুইনাসের রাজনৈতিক অবদান বা রাষ্ট্রদর্শন বিশ্লেষণ করলে অধ্যাপক ডানিং কর্তৃক মন্তব্যটিকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে হয়। তিনি মন্তব্য করেন, মধ্যযুগের দ্বিতীয়ার্ধের পণ্ডিতকুলের মধ্যে এবং সম্ভবত সকল পণ্ডিতবর্গের মধ্যে একুইনাস ছিলেন শ্রেষ্ঠতম পণ্ডিত ব্যক্তি। নিম্নে তাঁর রাষ্ট্রদর্শন আলোচনা করা হলো:
১. রাষ্ট্রের ভূমিকা: একুইনাস বিশ্বাস করতেন, সুন্দর ও সৎ জীবন ও জীবিকার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক কল্যাণ অপরিহার্য এবং এর মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের। মুক্ত আত্মার জন্য ও সৎ জীবনবোধের জন্য চার্চ যাতে কাজ করে যেতে পারে সেজন্য রাষ্ট্রে উপযুক্ত পরিবেশ গঠনের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা চার্চের সহযোগিতার ফলে নাগরিক জীবন সুশৃঙ্খল হতে বাধ্য।
২. সরকারের শ্রেণিবিভাগ: একুইনাস এরিস্টটলের মতো মিশ্র প্রকৃতির সরকারের সপক্ষে মত প্রদান করেন। এরিস্টটলের ন্যায় একুইনাসও সংখ্যা ও উদ্দেশ্যের নীতির উপর ভিত্তি করে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। এরিস্টটলের মতো তিনিও উত্তম সরকার এবং বিকৃত সরকারের পার্থক্য নির্ণয় করেছেন। তাঁর মতে, রাজতন্ত্রই উত্তম সরকার। তবে একুইনাস রাজার অপ্রতিহত ক্ষমতার পরিবর্তে সীমিত ক্ষমতার পক্ষে মতামত প্রদান করেন।
৩. রাষ্ট্রের উৎপত্তি: রাষ্ট্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে একুইনাস এরিস্টটলকে নিঃসংকোচে অনুসরণ করেছেন। এরিস্টটলের মতো তিনিও বলেছেন, “রাষ্ট্র একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান এবং মানুষের সহজাত ও ইতিবাচক সামাজিক প্রবৃতিই রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রধান কারণ।” তিনি আরও বলেছেন, মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। এ লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য সেবার ভিত্তিতে পারস্পরিক চুক্তিবোধের ফলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ও সুশৃঙ্খলাবদ্ধ।
৪. কার্যকারণ তত্ত্ব: একুইনাস এর সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন তার বিশ্বপ্রকৃতির ধারণার এক বিমূর্ত প্রতীক। তিনি তার বিখ্যাত ‘Summa Theologica’ গ্রন্থে বলেছেন, বিশ্ব প্রকৃতির ন্যায় মানবসমাজও একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও নিয়মের অধীন। এ নিয়ম অনুসারে নিম্নশ্রেণি উচ্চশ্রেণির আদেশ দ্বিধাহীন চিত্তে ও নিঃসংকোচে পালন করবে এবং উচ্চশ্রেণি নিম্নশ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ ও পথ প্রদর্শন করবে। এরিস্টটলের তালে সুর মিলিয়ে বলেছেন, যেহেতু প্রক্রতির সবকিছুই পূর্ণতা অর্জনের জন্য নিয়োজিত, সেহেতু মানুষকে এসব পথ অনুসরণ করতে হবে। তিনি বলেছেন, মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠতম অংশ হলো আত্মা এবং জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য মুক্তি। সুতরাং শুধু যুক্তিনির্ভর হলে আত্মার মুক্তি ঘটবে না, প্রয়োজন যুক্তির পাশাপাশি ধর্মবিশ্বাস ও ঈশ্বরের পরম করুণা।
৫. আইনতত্ত্ব: একুইনাস বিশ্বাস করেন যে, যদি রাষ্ট্রকে তার নাগরিকগণকে নৈতিকভাবে উন্নতি করতে হয় এবং তাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য লাভের জন্য সাহায্য করতে হয়, তাহলে কেবলমাত্র আইনানুযায়ী রাষ্ট্রের ক্ষমতার ব্যবহার প্রয়োগ করা কর্তব্য। তিনি আইন সম্পর্কে বলেছেন, “Law is ordinance of reason for the common goods promulgated by him who has the care of a community.” একুইনাস আইনকে চারভাগে ভাগ করেছেন। যেমন- শাশ্বত আইন, প্রাকৃতিক আইন, স্বর্গীয় আইন এবং মানবিক আইন। তাঁর মতে, এ চারটি আইন বিভিন্নভাবে প্রকাশ হলেও মূলত একই যুক্তিরই চারটি বিভিন্ন প্রকাশমাত্র।
৬. দাসপ্রথা: একুইনাস এরিস্টটলের ন্যায় দাসতত্ত্ব সমর্থন করেন। একুইনাস বিশ্বাস করেন দাসত্ব একান্তভাবেই স্বাভাবিক। তিনি আরও বলেছেন, যুদ্ধে পরাজিত হলেও সৈনিকগণ ক্রীতদাসে পরিণত হয়। তবে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার চেয়ে সৈনিকদের সাহসের সাথে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করাই ভালো।
৭. চার্চ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক: একুইনাসের মতে, পার্থিব সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য রাষ্ট্র কেবল মিটাতে পারে। কিন্তু আত্মার মুক্তি ও উন্নত জীবনের জন্য প্রয়োজন খ্রিস্টীয় চার্চের প্রতি অনুগত থাকা। একুইনাসের মতে, চার্চ রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং তা হলো রাষ্ট্রের সম্পূরক। চার্চ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ণয়ে একুইনাস মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার প্রভাবমুক্ত হতে পারে নি।
৮. ধর্মতত্বজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা: একুইনাস ধর্মতত্ত্বকে সকল জ্ঞানের ঊর্ধ্বে স্থান দেন। তাঁর মতে, প্রাকৃতিক জগতের ঊর্ধ্বে যে অন্য এক বৃহত্তর জগৎ আছে তা হলো ধর্মতত্ত্ব। দৃশ্যমান প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও দর্শন যে জ্ঞানের সূচনা করে ধর্মতত্ত্ব তার পরিসমাপ্তি ঘটায়।
৯. ন্যায়বিচার সম্পর্কিত ধারণা: এরিস্টটলকে অনুসরণ করে টমাস একুইনাস ন্যায়বিচারকে দু’ভাগে ভাগ
করেছেন। সাম্যমূলক ও বন্ধনমূলক। মূর্ত নির্দিষ্ট লোকদের পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে সাম্যমূলক ন্যায়ের ভিত্তিতে, মানুষ ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত বণ্টনমূলকতার উপর। পক্ষান্তরে, সময়ের জন্য নাগরিকের যতখানি অংশ আছে, তার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাবে। সমাজের প্রশাসন এমনভাবে পরিচালিত হবে যাতে করে সাম্য প্রতিষ্ঠা হয়। একইসঙ্গে আসবে ন্যায়বিচার। সাম্য ও ন্যায়বিচারকে সেন্ট টমাস একই দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন।
উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, একুইনাস মধ্যযুগের মত একটি অরাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান দখল করে পুরো সমাজ কাঠামোকে যেভাবে বিশ্লেষণ করে যুক্তিভিত্তিক আলোচনা করেছেন তা শুধু বিস্ময়করই নয়, রীতিমতো অবিশ্বাস্য। তার দর্শনের মূল বিষয় ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শক্তিকে একত্রিত করা। তাই সেবাইনের ভাষায় বলা যায়, “একুইনাসের দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, এটি এমন এক প্রকার সার্বজনীন সংযোগ সাধনকারী এবং সর্ব পরিব্যাপ্তি পদ্ধতি যার প্রধান উদ্দেশ্য ঐক্য এবং সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করা।”