সেন্ট টমাস একুইনাসের আইনের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, সেন্ট টমাস একুইনাসের আইন তত্ত্বটি বর্ণনা কর।

অথবা, সেন্ট টমাস একুইনাস কিভাবে আইনের শ্রেণিবিভাগ করেছেন? বর্ণনা কর।

অথবা, সেন্ট টমাস একুইনাস প্রদত্ত আইনের প্রকারভেদ সম্পর্কে যা জান লিখ।

উত্তরঃ ভূমিকা: একুইনাসের মতে, রাষ্ট্র একটি অর্থপূর্ণ সংস্থা, নাগরিকদের নৈতিক জীবনকে উন্নততর করা তথা জীবনের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করাই এর কাজ। এ কাজ সম্পন্ন করতে হলে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রয়োগ করতে হবে আইন অনুসারে। তাই তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আইনের শ্রেণিবিভাগ।

আইনের শ্রেণিবিভাগ: একুইনাস তার সুপ্রসিদ্ধ Summa Theologica গ্রন্থে আইনকে সর্বমোট ৪ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা:

ক. শাশ্বত আইন (Eternal Law);

খ. প্রাকৃতিক আইন (Natural Law);

গ. ঐশ্বরিক আইন (Divine Law);

ঘ. মানবীয় আইন (Human Law)।

এ চতুর্বিদ আইন যুক্তির চারটি প্রকাশ মাত্র। বিশ্ব প্রকৃতির চার পর্যায়ে একই যুক্তিবাদ চাররূপে প্রতিভাত। নিয়ে সেগুলো বর্ণনা করা হলো:

ক. শাশ্বত আইন: একুইনাস শাশ্বত আইনকে সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদা দিয়েছেন। শাশ্বত আইনের নির্দেশে অন্যান্য আইনকে মেনে চলতে হবে। এ আইন নিখিল বিশ্বের একটি অংশ। তার মতে শাশ্বত আইন ও ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার বিচারবুদ্ধি প্রায় সমার্থক। ঐশ্বরিক প্রজ্ঞায় শাশ্বত আইনের আকারে পার্থিব সমাজে প্রচলিত। সৃষ্টিকর্তার প্রজ্ঞা ও সদাচার মানুষের মধ্যে প্রতিফলিত এবং এ ক্ষমতাবলে সে শাশ্বত আইনে অংশগ্রহণ করতে পারে। অতএব শাশ্বত আইনকে সমাজবহির্ভূত কোন বিষয় বলে মনে করা অনুচিত।

অধ্যাপক সেবাইন (Prof. Sabine) বলেছেন, “The eternal law is practically identical with the reason of God. It is eternal plan of divine wisdom by which the whole creation is ordered.”

খ. প্রাকৃতিক আইন: সৃষ্ট বস্তুতে ঐশী চুক্তির প্রতিফলনকে বলা হয় প্রাকৃতিক আইন। এ শাশ্বত বিশ্বে চিরন্তন আইনে যেটুকু প্রতিফলন ঘটেছে তাই প্রাকৃতিক আইন। এ আইন মানুষসহ প্রতিটি জীব ও বস্তুর প্রকৃতি ও প্রফাতার প্রতিফলন হয়। ফলে মানুষ কল্যাণকে গ্রহণ এবং অকল্যাণকে বর্জন করতে চায়। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় প্রয়াসী হয় এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে যেটুকু সার্থক জীবন সম্ভব তা পেতে চায়। প্রাকৃতিক আইনের প্রভাবেই মানুষ সমাজে বাস করে আপন জীবন রক্ষা, সন্তান উৎপাদন, শিক্ষা দানে উৎসাহী এবং জ্ঞান সন্ধানী হয়।

এরিস্টটল এসব প্রবৃত্তিকে যুক্তিবাদী সহজাত প্রবণতা বলেছেন। প্রাকৃতিক আইন কোন বাধ্যতামূলক প্রকৃতির নয়। সামাজিক নীতিবোধ বা কল্যাণমূলক নীতির সাথে এর পরিবর্তন হতে পারে। যেমন প্রারম্ভে কোন সম্পত্তি ও দাসত্বের ধারণা ছিল না তবে এদেরকে প্রকৃতিগত সংগঠনরূপে গণ্য করা যায়। অধ্যাপক সেবাইন (Sabine) বলেন, “Natural law enjoys all that is implied to give these human inclinations their widest scope.”

গ. ঐশ্বরিক আইন: মানবের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্য আল্লাহ ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমে যেসব প্রত্যাদেশ বা ওহি নাজিল করেন, তাকেই ঐশ্বরিক আইন বলা হয়। একটি যুক্তির ভিত্তিতে বিধাতা তাঁর প্রেরিত পুরুষদের মাধ্যমে এ আইন মানুষের নিকট প্রেরণ করেন। ঐশ্বরিক আইন নিতান্তই স্রষ্টার দান। সিনাই পর্বতে হযরত মুসার মাধ্যমে ইহুদিদের কাছে, যিশু খ্রিস্টের মাধ্যমে খ্রিস্টানদের কাছে এবং হযরত মুহাম্মদ (স) এর মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে যে আইন প্রকাশ করা হয়, তাকেই বলে ঐশ্বরিক আইন।

ঐশ্বরিক আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Prof. Sabine বলেছেন, “Divine law is a gift of goods grace rather than a discovery of natural reason.” ঐশ্বরিক আইন মানুষের আধ্যাত্মিক ও জাগতিক জীবন উভয়ের উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রাখে।

ঘ. মানবিক আইন: টমাস একুইনাস মানবিক আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, মানবিক আইন সাধারণ কল্যাণের জন্য যুক্তির নির্দেশ মানবিক আইনে কোন প্রকার স্বেচ্ছাচারের সুযোগ নেই। যুক্তিভিত্তিক না হলে কোন নির্দেশ আইন হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় না। মানবিক আইনের বিষয়বস্তু শুধুমাত্র মানবিক এবং জাগতিক। কোন ধর্মীয় বিষয়ে মানবিক আইন প্রণীত হতে পারে না। সেন্ট টমাস একুইনাস মানবিক আইনের ক্ষেত্রে আনুগত্যের কথা বলেছেন। এ আনুগত্য একদিকে যেমন রাজনৈতিক অন্যদিকে তেমনি নৈতিক। আইনের লক্ষ্য সাধারণ কল্যাণ। এর পিছনে থাকে সমাজের মানুষের চাহিদা, সহযোগিতা ও সমর্থন। আইনকে তাই মানুষের বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এ আইন সম্পর্কে অধ্যাপক ডানিং (Prof. Dunning) বলেছেন, “Human law is the application, by human reason of the precepts of natural law to particular earthly conditions.”

সমালোচনা: সেন্ট টমাস একুইনাস এর আইনতত্ত্বকে বিভিন্নভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:

১. তিনি আইনকে চারভাগে বিভক্ত করে সবকিছুকে এক করে দেখেছেন।

২. তিনি মানবিক আইনের উপর প্রাকৃতিক আইনকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষকে ধর্মীয় গোঁড়ামির দিকে ঠেলে দিয়েছেন।

৩. প্রাকৃতিক আইনকে দু’ভাগে ভাগ করে প্রাকৃতিক নিয়ম ভঙ্গ করেছেন।

৪. তিনি শাশ্বত আইন, প্রাকৃতিক আইন ও ঐশ্বরিক আইনকে ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারেন নি।

৫. তিনি খ্রিস্টীয় যাজকদের অভিমতকে প্রত্যাখ্যান করে টিউটদের অভিমতকে গ্রহণ করেছেন।

৬. তিনি শ্বাশত, প্রাকৃতিক ও ঐশ্বরিক আইনের ঠিকমতো ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গতা পায় নি।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ‘একুইনাসের আইনতত্ত্ব’ ধারণাটির কিছুটা সমালোচনা থাকলেও বাস্তবে তার উৎস এক ও অভিন্ন। তাঁর আইনতত্ত্বের ধারণা সম্মিলিতভাবে দার্শনিকের ধারণার সাথে মিশে বর্তমান যুগ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে।