আওয়ামী মুসলিম লীগ এর কর্মসূচি কী ছিল?

অথবা, আওয়ামী মুসলিম লীগ এর কর্মসূচিগুলোর বিবরণ দাও।

অথবা, আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচিগুলো কী কী ছিল? আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের দুই বছরের মধ্যেই মুসলিম লীগের মধ্যে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি গড়ে উঠে। পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে অবাঙালিরা নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তারা নানা উপায়ে সুবিধা পেতে থাকে। মুসলিম লীগের মধ্যেও শাসকগোষ্ঠীর অনুগত একটি অংশ সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে থাকে। স্বভাবতই নাজিমউদ্দিন পন্থিদের বিরোধী একটা অংশের মধ্যে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার হয়। মুসলিম লীগের এ ক্ষুব্ধ অংশটুকু ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার মোঘলটুলিতে এক সম্মেলনে মিলিত হয়ে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করে। এ গ্রুপের সাথে শীঘ্রই মুসলিম লীগের বিবাদ দেখা দেয় এবং এ বিবাদের ফলস্বরূপ ১৯৪৯ সালের জুন মাসে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয়।

আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচিসমূহ: নবগঠিত ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ১২ দফা কর্মসূচি ঘোষণা

করে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান কর্মসূচি নিচে আলোচনা করা হলো:

১. আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন: নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম দাবি ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন। এজন্য তারা তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের কাছে লিখিতভাবে দাবি জানায়। পার্টির সদস্যদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম চালায় এবং বিভিন্ন সম্মেলনে এ দাবি উত্থাপন করে।

২. পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন: পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা আন্দোলন চালায়। কেননা পাকিস্তান স্বাধীনতার সময় আইনে উল্লেখ ছিল যে, অতি শীঘ্রই প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তান স্বাধীনতার ৩ বছরের মধ্যেও যখন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, তখন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে আন্দোলন চালায়।

৩. বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি দান: আওয়ামী মুসলিম লীগ দাবি উত্থাপন করে। পাকিস্তানের অর্ধেকের বেশির ভাগ জনগণের মাতৃভাষা বাংলা। তাই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য তারা আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।

৪. পাট শিল্পকে জাতীয়করণ: পাকিস্তানে উৎপাদিত পাটের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ পাটই পূর্ব পাকিস্তানে তথা পূর্ব বাংলায় উৎপাদন করা হতো। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ এর সুবিধা ভোগ করতে পারত না। তাই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ দাবি উত্থাপন করে যে, পাট শিল্পকে জাতীয়করণ করতে হবে এবং সকলকে এর সমান সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে।

৫. জমিদারি ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করা: ক্ষতিপূরণ না করে জমিদারি ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করার জন্য ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ তৎকালীন সরকারের কাছে দাবি জানায়। কারণ জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত না করলে ধনীগরিব বৈষম্য হ্রাস পাবে না।

৬. পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা: আওয়ামী মুসলিম লীগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি ছিল পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। এজন্য তারা জনগণের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানায়।

৭. সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন: আওয়ামী মুসলিম লীগের আরেকটি প্রধান কর্মসূচি ছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করা। এ উদ্দেশ্যে তারা পূর্ব বাংলায় স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করা এবং পাট শিল্পকে জাতীয়করণ করার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ মূলত মুসলিম লীগ সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষারূপে স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে এসে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করে। পরবর্তীতে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ গঠন করা হয়। যে দলের প্রভাব আজও স্বীকৃত।