অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বাংলা ভাষার ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুটি অংশ মাত্র ২৪ বছর একই রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় টিকে থাকে। ১৯৭১ সালে এ রাষ্ট্রের পূর্ব অংশ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে কেন পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দ্বিখণ্ডিত হলো তার পেছনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণসহ বিবিধ বৈষম্যমূলক আচরণ রয়েছে। এর মধ্যে মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনা ও প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশের মধ্যে জলবায়ু, সমাজ কাঠামো, উৎপাদন ব্যবস্থা, জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পোশাক পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি কোনকিছুতেই মিল ছিল না। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্যের ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে গিয়ে স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’ এর আবির্ভাব ঘটে।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বাংলা ভাষার অবদান ভাষা আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এ আন্দোলনের অবদান অপরিসীম। এ আন্দোলন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। নিচে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বাংলা ভাষার অবদান তুলে ধরা হলো:
১. অধিকার আদায়ের আন্দোলন ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলন। এ আন্দোলন প্রথমে সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। সুতরাং ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি সর্বপ্রথম অধিকার সচেতন হয়ে উঠে এবং তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়।
২. বাঙালি জাতীয়তার উন্মেষ ভাষা আন্দোলন বাঙালি জনগণের মধ্যে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটায়। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালিরা সর্বপ্রথম নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা, স্বতন্ত্র অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সাথে শুধু ধর্মের বন্ধন ছাড়া বাঙালিদের যে আর কোনো বন্ধন বা সম্পর্ক নেই সে সম্পর্কে তারা প্রথমবারের মতো এ আন্দোলনের মাধ্যমে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়।
৩. স্বাধিকার আন্দোলন: ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কবল থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে সক্ষম হয়।
৪. বাঙালিদের দাবি সচেতনতা: ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জনগণ দাবি সচেতন হয়ে ওঠে। বাঙালি জনগণ তাদের ন্যায়সংগত দাবিসমূহ উত্থাপন করে তা আদায় করার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়।
৫. বাঙালির প্রথম বিদ্রোহ: ভাষা আন্দোলন ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের প্রথম বিদ্রোহ। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন নিয়ে বাঙালি জাতি সর্বপ্রথম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল।
৬. সংগ্রামী চেতনার সূচনা: ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি উপলব্ধি করতে শেখে যে, সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তাদেরকে বেঁচে থাকার পথ খুঁজতে হবে এবং দাবিদাওয়া আদায় করতে হবে।
৭. মধ্যবিত্ত শ্রেণির শুরুত্ব: ভাষা আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, উকিলসহ সকল মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভাষা আন্দোলনের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে এবং তারা এক সময় রাজনীতির কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়।
৮. ছাত্রসমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি: ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার ছাত্রসমাজের ভূমিকা ও মর্যাদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তারা একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে থাকে।
৯. স্বাতন্ত্র্যবোধের বিকাশ: ভাষা আন্দোলন বাঙালি জনগণকে স্বাতন্ত্র্যবোধের বিকাশ ঘটাতে সহায়তা করে। তারা মনে করে যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বসবাস করলেও তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র স্বার্থ, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
১০. জাতীয় একাত্মতা ও সংহতির চেতনা: ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে নবতর ও ভিন্নতর জাতীয় একাত্মতা ও সংহতিবোধ সৃষ্টিতে প্রেরণা যুগিয়েছিল। এ আন্দোলন বাঙালিদের একটি আলাদা জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করে।
১১. অর্থনৈতিক মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত ‘বাংলা ভাষা একটি অনুন্নত ও অনগ্রসর ভাষা’- এ রকম একটি ইঙ্গিতের মাধ্যমে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার জন্য উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এসব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে বাঙালিদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেছিল।
১২. অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ প্রশস্ত ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় বিরোধী দল তথা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ প্রশস্ত করেছিল। ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে গণতন্ত্রী দল, ছাত্র ইউনিয়নসহ অসামপ্রদায়িক ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে এবং পূর্ব বাংলার আওয়ামী মুসলিম লীগ এর নাম থেকে মুসলিম কথাটি বর্জন করে দলটি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে।
১৩. জাতীয়তাবাদের বিকাশ: ভাষা আন্দোলন জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটায়। আর এ জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ধাপে ও স্তরে স্তরে ভাষা আন্দোলন যুগিয়েছিল আন্তরিক মনোবল, সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়, যার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
১৪. আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ভাষা আন্দোলন তথা ভাষার দাবিতে পরিচালিত আন্দোলন বাঙালিদেরকে রক্তের বিনিময়ে জাতীয়তার দাবি আদায়ের ব্যাপারে উৎসাহী করে তোলে। এরই সাথে বাঙালি জাতি পায় তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের উপায়।
১৫. বৈপ্লবিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়: ২১ ফেব্রুয়ারির বিয়োগান্তক ঘটনায় বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ সংগ্রামী চেতনায় জেগে ওঠে। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী নির্বিশেষে সর্বস্তরের গণমানুষের মধ্যে এক বৈপ্লবিক চেতনার উন্মেষ ঘটে যা পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা যোগায়।
১৬. বিভিন্ন আন্দোলনের উৎসাহ দান: ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মাঝে যে কোনো ধরনের সংকট মোকাবিলার কৌশল জাগ্রত হয়। যেমন- ভাষা আন্দোলন পরবর্তীকালে ৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের আন্দোলন, ‘৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলনে জনগণ সোচ্চার হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক শিক্ষা থেকে।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের আবির্ভাবের কারণ বহুবিধ হলেও এগুলোর মূল ছিল ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী চেতনা। ভাষা আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী চেতনা ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, মুসলিম লীগের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, এমনকি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পথনির্দেশক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।