অথবা, পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং
যুক্তফ্রন্ট বিপুল আসনে জয়লাভ করে। নির্বাচনে জয়লাভের পর যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন প্রক্রিয়া শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামান ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনে আহ্বান জানায়। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও মাত্র ৫৬ দিনের মধ্যে নির্বাচিত এ মন্ত্রিসভা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বাতিল হয়।
পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের শাসনামল: ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। ৩ এপ্রিল (১৯৫৪) শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক চার সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ফজলুল হক ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়া অন্য তিনজন সদস্য ছিলেন আবু হোসেন সরকার, আশরাফ উদ্দীন আহমদ চৌধুরী এবং সৈয়দ আজিজুল হক (নাল্লা মিয়া)। প্রথম দফা মন্ত্রিসভা গঠনের ১ মাস ১২ দিন পর ১৫ মে এ মন্ত্রিসভা প্রসারিত হয়। মন্ত্রিসভায় আরো ১০ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়। এর মধ্যে ৭ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করার পর মাত্র ১৫ দিন স্থায়ী হয়েছিল এ মন্ত্রিসভা। নিচে পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্টের শাসনামল উল্লেখ করা হলো:
১. যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় যুক্তফ্রন্ট। নির্বাচনে জয়লাভের পর ৩ এপ্রিল ফজলুল হক চার সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে। তিনি নিজে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এরপর ১৫ মে আরো নতুন ১০ জন সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করা হয়।
২. ফজলুল হকের আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থান: ফজলুল হক প্রথম যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন সে মন্ত্রিসভার প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ পার্টির কোনো সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়নি, যাতে আওয়ামী লীগ ফজলুল হকের প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে আলাপ-আলোচনার মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন হয় এবং ৭ জন আওয়ামী লীগ সদস্য মন্ত্রিসভায় স্থান পায়।
৩. শেখ মুজিবুর রহমান এবং আতাউর রহমানকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত: ১৯৫৪ সালের ৩০ এপ্রিল এ. কে. ফজলুল হক এক সরকারি সফরে কলকাতায় যান। তিনি কলকাতায় এক সংবর্ধনায় দুই বাংলার শিক্ষা এবং সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে একটি ভাষণ দেন। এর ফলে পাকিস্তান সরকার তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও আতাউর রহমানকে নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন।
৪. যুক্তফ্রন্ট সরকারের অযোগ্যতা: আওয়ামী লীগের সদস্যরা মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে আওয়ামী লীগ বিরোধী
ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করে মন্ত্রিসভায়। ফলে মন্ত্রিসভার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। নিউইয়র্ক টাইমস এর সংবাদদাতা জন, পি. কালহান এক রিপোর্টে লিখেছিলেন যে, ফজলুল হক পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যার ফলে ফজলুল হককে পাকিস্তান আর সমর্থন দিতে চায়নি।
৫. যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের পর থেকে এর বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। উদ্দেশ্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ শাসন পরিচালনায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের যে অক্ষমতা তা জনসম্মুখে তুলে ধরা। এর মধ্যে কেন্দ্র কর্তৃক যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হচ্ছিল। ফজলুল হকের বিরুদ্ধে বিছিন্নতাবাদের অভিযোগ আনা হয়। তৎকালীন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী চক্রান্ত করে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২(ক) ধারা জারি করে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় এবং কেন্দ্রের শাসন চালু করে।
৬. গভর্নরের শাসন প্রতিষ্ঠা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও অযোগ্যতার অজুহাতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে গভর্নরের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে পূর্ব বাংলায়। ১৯৫৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ. শাসনব্যবস্থা কায়েম ছিল।
৭. রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টি: যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করলে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। এ সময় পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক দমন ও নিপীড়ন চালায়। যুক্তফ্রন্টের ৬৫৯ জন নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ফজলুল হককে গৃহবন্দি এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে পূর্ববাংলা থেকে বিতাড়িত করা হয়।
৮. আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা গঠনের প্রচেষ্টা: যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল হলে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলায় পুনরায় সরকার গঠনের প্রচেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীকে পূর্ব বাংলায় সরকার পুনর্গঠনের মদদ দেয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা গ্রহণ করেননি।।
৯. যুক্তফ্রন্টের বিভক্তি: যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল হলে জোটের বিভিন্ন অংশ পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে শুরু করে। এতে শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্টের বিভক্তি ত্বরান্বিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা ফজলুল হকের বিরুদ্ধে মতামত দিলে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ভিন্ন ভিন্ন দলের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে।
১০. ফজলুল হকের গভর্নর পদে যোগদান: মন্ত্রিসভার অস্তিত্বকে অক্ষুণ্ণ রাখতে আবু হোসেন ফজলুল হককে ১৯৫৬ সালে ৫ মার্চ পুনরায় পূর্ব বাংলার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত করেন। আবু হোসেনের মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হলেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
১১. আবুল হোসেন মন্ত্রিসভার পতন: ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশনের ব্যবস্থা করা হয়। আবু হোসেন নিশ্চিত পরাজয় জেনে উক্ত অধিবেশন নাকচ করেন। কিন্তু পরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রচেষ্টায় ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট আবু হোসেন সরকারের পতন ঘটে।
১২. কোয়ালিশন সরকার গঠন: ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান।
১৩. ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ন্যাপ গঠন: ১৯৫৭ সালের ২৪ জুলাই ‘ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ পার্টি’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরই ন্যাপ গঠিত হয়। ন্যাপ গঠিত হলে আওয়ামী লীগ কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
১৪. আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পরাজয়: ১৯৫৮ সালের ১৮ জুন পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে এক ভোটের আয়োজন করা হয়। উক্ত ভোটে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে কেন্দ্রের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৫. আইন পরিষদে কলঙ্কজনক অধ্যায়: ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আইন পরিষদের পতনের এক মাস আগে ডেপুটি স্পিকার জনাব শাহেদ আলীকে কৃষক শ্রমিক পার্টি এবং তার সমর্থক দলের সদস্যবৃন্দ ডেস্কের সাথে যুক্ত লেখার এজন্য নির্দিষ্ট স্থানের ভগ্নাংশ ছুড়ে মারে। এতে তিনি মারাত্মক আহত হন এবং ১৯৫৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মারা যান।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা এবং তাদের শাসনামল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ লাভ করে এবং ১৯৫৪ সালে মার্চ থেকে ১৯৫৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত সাতবার মন্ত্রিসভা এবং তিনবার গভর্নরের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।