১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রেক্ষাপট এবং ফলাফল বর্ণনা কর।

উত্তর। ভূমিকা: পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত এবং যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ নিয়ে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলার উপর বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে। পূর্ব বাংলার উপর বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের বিপরীতে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। এর ফলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চের উদ্ভব ঘটে।

নির্বাচনের প্রস্তুতি: পূর্ব পাকিস্তানে ভোটারদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রথম সাধারণ নির্বাচন ছিল যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। এ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধভাবে সংঘটিত হয়েছিল। নিচে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রস্তুতি আলোচনা করা হলো।

১. স্বচ্ছে ভোটার তালিকা প্রকাশকরণ: ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে ভোটার তালিকা চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করা হয়। উক্ত ভোটার তালিকা রেজিস্ট্রি অফিসে, রিটানিং অফিসারদের অফিসে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যেক মৌজার সরদারদের অফিসে, সিলেট জেলার সার্কেল সাব ডেপুটি কালেক্টরের অফিসে, ইউনিয়ন বোর্ড অফিস এবং মিউনিসিপ্যাল এলাকায় মিউনিসিপ্যালিটি অফিসসহ প্রভৃতি জায়গা জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়, যাতে করে জনগণ এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারে।

২. সঠিক নিয়মে মনোনয়ন জমাদান মনোনয়ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম ও দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়। মনোনয়নের ফরম ছাপিয়ে, হাতে লিখে বা টাইপ করে জমা দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়েছিল।

৩. জামানত দাখিল: যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জামানত প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। তফসিলি নির্বাচনি এলাকার প্রার্থীদের ১০০ টাকা করে জমা দেওয়া এবং তফসিলি নির্বাচনি এলাকা ব্যতীত অন্যান্য নির্বাচনি এলাকার প্রার্থীদের ২৫০ টাকা করে জমা দেওয়ার নিয়ম জারি করা হয়। উক্ত জামানত রেভিনিউ ডিপোজিট খাতে জমা দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়েছিল।

৪. প্রতীক নির্দিষ্টকরণ: ১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রতীক নির্দিষ্টকরণ করা হয়। প্রার্থীদের সুবিধার জন্য ২৪টি প্রতীক নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। যাতে করে তারা উক্ত প্রতীকসমূহ ব্যালট বাক্সে ব্যবহার করতে পারে। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জন্য নৌকা প্রতীক এবং মুসলিম লীগের জন্য হারিকেন প্রতীক নির্দিষ্ট করা হয়।

৫. ভোটকেন্দ্র স্থাপন: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য পূর্ব বাংলায় প্রায় ৫ হাজার ১০টি ভোট কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ভোট গ্রহণ নিশ্চিত করতে রিজার্ভসহ ৭ হাজার ৮৩ জন প্রিজাইডিং অফিসার এবং ২৪ হাজার পোলিং অফিসার নিযুক্ত করা হয়।

৬. আঙ্গুলে কালির ছাপ প্রচলন: এ নির্বাচনে অসদুপায় যাতে কেউ গ্রহণ করতে না পারে এ লক্ষ্যে ভোট গ্রহণের সময় প্রত্যেক ভোটারের হাতে কালির ছাপ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়।

৭. পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক কেন্দ্র ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা সুষ্ঠু করার জন্য পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পৃথক

৮. বুথ স্থাপন করা: ভোটদান সহজীকরণের জন্য বিভিন্ন স্থানে বুথ স্থাপন করা হয়। ভোটদানের জন্য যাতে ভোটারদের পাঁচ মাইলের বেশি দূরে যেতে না হয় সে উদ্দেশ্যে জায়গায় জায়গায় ভোট গ্রহণের জন্য বুথ স্থাপন করা হয়।

৯. ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা: ভোট গ্রহণের সুবিধার জন্য ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা হয়। এর ফলে ভোট গ্রহণ ও ভোট গণনায় অনেক সুবিধা হয়। এ নির্বাচনে প্রায় দুই কোটি ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছিল।

১০. ভোট গ্রহণের সময়কাল: ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক এ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের সময়কাল নির্দিষ্ট করা হয় ৫ দিন। ৮ মার্চ থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত এবং ভোট গ্রহণের শুরু হয় সকাল ৯.৩০ থেকে বিকাল ৪.৩০ মিনিট পর্যন্ত। যদি ভোটকেন্দ্র ভোটার উপস্থিতি থাকে তাহলে ৪.৩০ এর পরেও ভোট নেওয়ার নিয়ম জারি করা হয়।

১১. ডাকযোগে ভোট প্রদান: যে সকল ভোটারগণ কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকারের কাজে নিজ নিজ এলাকায় তথা ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে ছিল এবং যারা নির্যাতনমূলক আইনে আটকা ছিল তাদের জন্য ডাকযোগে নিজেদের ভোট প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনি ফলাফল: ১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এ নির্বাচনে ৩০৯টি আইনসভার আসনের মধ্যে মুসলিম আসন ছিল ২৩৭টি এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের আসন সংরক্ষিত ছিল ৭২টি। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি, মুসলিম লীগ ৯টি, নির্দলীয় সদস্যগণ ৪টি এবং খেলাফতে রব্বানী পার্টি লাভ করে ১টি আসন। আইনসভায় অমুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ৭২টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ২৪টি, তফসিলি ফেডারেশন ২৭টি, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট ১৩টি, খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ১টি, বৌদ্ধ সম্প্রদায় ২টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি এবং নির্দলীয় সদস্যগণ ১টি আসন লাভ করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন ছিল একটি রাজনৈতিক মাইলফলক। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের অত্যাচার দমন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনতা ভোট প্রদান করে। অন্যদিকে, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি ইশতেহারে ছিল পূর্ব বাংলার গণমানুষের দাবি। ফলে সহজে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। এ নির্বাচনের ফলাফল ও তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী।