অথবা, আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল ও শাসনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।
উত্তর। ভূমিকা: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবার দীর্ঘ নয় বছর পর সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ দ্বিতীয় গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সারাদেশে সামরিক শাসন জারি করেন। আর তার মাত্র ২০ দিন পর ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান তাকে সরিয়ে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে।
আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্রকে হত্যা করে ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করে। ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে জেনারেল আইয়ুব খানকে সর্বাধিনায়ক করা হয়। অতঃপর ইস্কান্দার মির্জা আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে ১৯৫৯ সালে সাধারণ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দলের ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যান। এদিকে আইয়ুব মনে মনে উচ্চাভিলাষী সন্ধি এটে আছে মনে মনে। ইস্কান্দার মির্জা তা বুঝে আইয়ুব পূর্ব পাকিস্তানে সফরকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা লে. জেনারেল মুসাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন। তাকে সকল কিছু থেকে সরিয়ে দেওয়ার আগে আইয়ুব খান এরূপ কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগেই তাঁর সামরিক শাসন জারির মাত্র ২০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৭অক্টোবর ১৯৫৮ সালে তিনি চারজন জেনারেলকে সশস্ত্র অবস্থায় পাঠিয়ে ইস্কান্দার মির্জাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। পরে তাকে বিমানযোগে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। একই সঙ্গে আইয়ুব খান নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করে।
আইয়ুব ক্ষমতা দখলের কারণ: আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল করার স্পৃহা একদিনের নয়। ১৯৫৪ সালে তিনি তার আত্মজীবনীতে রাজনীতিক হিসেবে এঁকেছিলেন। রাজনীতি সম্বন্ধে তার ছিল প্রচণ্ড নেতিবাচক ধারণা। তিনি মনে করেন এসবের মাধ্যমে দেশে অনৈক্য বিভেদ বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংস দেখা দেয়। আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের কারণসমূহ নিচে আলোচনা করা হলো:
১. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
২. ইস্কান্দার মির্জার ক্ষমতার লোভ।
৩. গণতান্ত্রিক সরকারের ব্যর্থতা।
৫. ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন।
৪. দলীয় শৃঙ্খলার অভাব।
৬. আমলাদের দৌরাত্ম্য।
৭. শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি।
৮. সংবিধান অকার্যকর হওয়া।
আইয়ুব শাসনের বৈশিষ্ট্য: আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জার হাত থেকে ক্ষমতা দখল করে ১৯৫৮ সালের ২৭অক্টোবর থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। নিচে আইয়ুব খানের দীর্ঘ প্রায় ১১ বছরের শাসন আমলের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো।
১. ১৯৫৬ সালের সংবিধান স্থগিত: ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভ করলে দীর্ঘ নয় বছর সময় লাগে সংবিধান প্রণয়ন করতে। অবশেষে ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়ন হয়। কিন্তু গণতন্ত্র ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় প্রথমে ইস্কান্দার মির্জা ও পরে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। পরে আইয়ুব খান এক আদেশ বলে ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল না করে স্থগিত করেন।
২. প্রাদেশিক সরকারের বিলুপ্তি: আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। তিনি পাকিস্তানের প্রদেশ বিলুপ্ত ঘোষণা করে সমগ্র পাকিস্তানকে কেন্দ্র থেকে শাসন করার পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তার শাসনামলে প্রাদেশিক সকল সরকারের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।
৩. জাতীয় পার্লামেন্টের বিলুপ্তি: আইয়ুব শাসনামলের পূর্বে ১৯৫৬ সালের গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়ন ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে যে পার্লামেন্ট ছিল আইয়ুব খান জাতীয় গণপরিষদ বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। অবশেষে আইয়ুব খান জাতীয় পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। আইয়ুব শাসন আমলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এটি।
৪. রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ: আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে আইয়ুব খান সকল প্রকার রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। এ সময় সকল প্রকার রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণ করা হয়। এর মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব হয়, যা আইয়ুব শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।
৫. বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সেনাশাসন বহাল থাকবে আইয়ুব খান তার ক্ষমতাবলে এক আদেশে জারি করেন। যতদিন পর্যন্ত কোন সুষ্ঠু বিকল্প ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত সামরিক শাসন অব্যাহত থাকবে। এ কথার প্রেক্ষিতে আইয়ুব খান ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকে থাকেন।
৬. প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্তি: আইয়ুব খান তার শাসন প্রারম্ভে ১৯৫৮ সালে সমগ্র পাকিস্তানকে একটি পাকিস্তানে পরিণত করেন। তিনি এক আদেশ বলে প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙে দেন, যা আইয়ুব শাসন আমলের এক অনবদ্য বৈশিষ্ট্য ছিল।
৭. রাজনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা: আইয়ুব গতানুগতিক শাসনব্যবস্থা বাতিল করে মৌলিক গণতন্ত্র নামে নিত্য নতুন শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করার পরিকল্পনা হাতে নেন। অতঃপর ১৯৬২ সালে প্রণীত সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করেন, যা আইয়ুব শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৮. ১৯৬২ সালের সংবিধান প্রণয়ন আইয়ুব খান ১৯৫৬ সালের সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করেন। তার চার বছর, পর ১৯৬২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করেন। এ সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রচলন। এছাড়া এ সংবিধানে গণভোটের ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। যা আইয়ুব খানের শাসন আমলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
৯. একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা: আইয়ুব শাসনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। আইয়ুব খান সকল ক্ষমতা এক হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। যাতে সকল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বিলীনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
১০. সরকার বিরোধী আন্দোলন: আইয়ুব সরকার এক পর্যায়ে বেসামরিকীকরণের প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে চায় কিন্তু জনগণ তা সমর্থন করেনি। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেন। শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি জানালে আইয়ুব সরকার দমনপীড়ন শুরু করে।
১১. মামলা দায়ের: আইয়ুব সরকারের শাসনামলে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। এ পর্যায়ে শেখ মুজিব ছয় দফা ঘোষণা করলে আইয়ুব সরকার তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করে মিথ্যা আগরতলা মামলা দায়ের করেন।
১২. দমনপীড়ন: আইয়ুব সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দমনপীড়ন। শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি পেশ করলে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের নামে মিথ্যা মামলা করা হয় এবং গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু জনগণের তীব্র আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
১৩. সামরিক হস্তক্ষেপের সূচনা: ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করলেও বিভিন্ন কারণে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সরকার গড়ে উঠেনি। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরাজিত হলেও জয়লাভকারী দল যুক্তফ্রন্টের হাতে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়নি। ফলে রাজনৈতিক অবস্থায় অস্থিরতা বিরাজ করলে সামরিক হস্তক্ষেপের সূত্রপাত হয়।
১৪. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব: আইয়ুব খানের শাসনামলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করেন। কোন আইন বা বিধিবিধানকে অসাংবিধানিক ঘোষণার ক্ষমতা বিচার বিভাগের ছিল না।
১৫. রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত শাসন আইয়ুব খানের ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে তারা নির্বাচিত হয়নি। এটিও আইয়ুব শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।
১৬. মৌলিক গণতন্ত্র: আইয়ুব সরকার ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ জারি করেন। এ দ্বারা ৪ স্তর বিশিষ্ট পিরামিড আকৃতির একটি কাঠামো সৃষ্টি করা হয়। স্তরগুলো হলো- ১. ইউনিয়ন কাউন্সিল, ২. থানা কাউন্সিল, ৩. জেলা কাউন্সিল, ৪. বিভাগীয় কাউন্সিল। আইয়ুবের এই মৌলিক গণতন্ত্র “বুনিয়াদি গণতন্ত্র” নামেও পরিচিত।
১৭. গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত: আইয়ুব খান ছিলেন সামরিক শাসক; তিনি সামরিক আইন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিনষ্ট করে। পরবর্তীতে তিনি গণতন্ত্রের নামে মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রহসন চালান। মূলত তিনি গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত করেন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, “১৯৫৮ সালের আইয়ুব শাসন ছিল মূলত সামরিক শাসন। এজন্য অবশ্য ১৯৪৭-৫৭ সাল পর্যন্ত স্থায়ী সরকার ব্যবস্থাও দায়ী ছিল। তাই শাসনতান্ত্রিক নিয়মানুযায়ী গণতান্ত্রিক শাসন যেখানে কার্যকরী হতে ব্যর্থ হয় সেখানে সামরিকবাহিনী সুযোগ করে বসবে। আইয়ুব শাসনের বেলায় তাই ঘটেছিল।