আইয়ুব খানের রাজনৈতিক নিপীড়নের বর্ণনা দাও।

অথবা, আইয়ুব খান যেভাবে রাজনৈতিক নিপীড়ন করেছেন তা আলোচনা কর।

উত্তর। ভূমিকা: আইয়ুব খান ছিলেন স্বৈরাচারী শাসক। সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের

রাজনৈতিক ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সামরিক শাসক হওয়ায় পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। আইয়ুব খানের কোনো জনসম্পৃক্ততা ছিল না। আইয়ুব খান তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত দীর্ঘস্থায়ী করতে রাজনৈতিক দমন পীড়ন শুরু করেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বহু রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড সভা সমাবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ছাত্র-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনগুলোর অফিস কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়।

আইয়ুব খানের রাজনৈতিক নিপীড়ন: আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের পর ছাত্র ও রাজনীতিবিদদের নির্যাতন ও নিপীড়নের মাত্রা বেড়ে যায়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আইয়ুব খান সামরিক শাসনের অধীনে একটানা ৪৪ মাস দেশে স্টিমরোলার চালায়। নিচে আইয়ুব খানের রাজনৈতিক নিপীড়ন বর্ণনা করা হলো:

১. এবডো (EBDO): জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভবিষ্যতে যাতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কোনরূপ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে তার প্রয়াস চালান আইয়ুব খান। এজন্য তিনি বিভিন্ন কালাকানুন প্রবর্তন করেন। আইয়ুব খান তার ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে ১৯৫৯ সালের ৭ আগস্ট এবডো (Elective Bodies Disqualification Order) নির্বাচিত সংস্থাসমূহের অযোগ্যতার আদেশ। এ আদেশ বলে যে কোনো নির্বাচনি সংস্থার প্রতিনিধিকে অসদাচরণের জন্য সাজা দেয়া যেত। রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপ, অসদুপায় অবলম্বন, দুর্নীতি প্রভৃতি অসদাচরণের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হয়। মূলত আইয়ুব খান রাজনৈতিক দমন ও নিপীড়নের জন্য এ আইন পাস করেন। এ আইন জারি করে আতাউর রহমান খান, আবু হোসেন সরকারসহ পাকিস্তানের উভয় অংশের মোট ৮৭ জন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদকে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়।

২. পড়ো (PODO): সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের বিচারের জন্য PODO (Public Office Disqualification Order) জারি করা হয়। স্বজনপ্রীতি, প্রিয়তোষণ ও ইচ্ছাকৃত কুশাসনের দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। রাজনৈতিক দমন, বিরোধী শক্তি এবং গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হয়।

৩. প্রেস এন্ড পাবলিকেশল অধ্যাদেশ সংশোধন ও নিয়ন্ত্রণ: আইয়ুব খান সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড শক্তহাতে দমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি সরকার বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করার লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশ সংশোধন করেন। বিশেষ অবস্থায় সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রকাশনা বন্ধ অথবা বাজেয়াপ্ত করা যাবে তা সুনির্দিষ্ট করা হয়।

৪. ভোটাধিকার হরণ: আইয়ুব খান মনে প্রাণে গণতন্ত্র বিশ্বাসী ছিলেন না। ১৯৬২ সালে সংবিধান কার্যকর করে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করেন। সৃষ্টি হয় ১৫৬ সদস্যবিশিষ্ট ক্ষুদ্রাকৃতির জাতীয় কাউন্সিল। যা উভয় প্রদেশের মধ্যে সমানভাবে বিভক্ত ছিল। এ খর্বাকৃতির আইনসভাটি সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতো না। ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচক মণ্ডলী কর্তৃক তারা নির্বাচিত হতো। মৌলিক গণতন্ত্রীরা আইয়ুব খানের সৃষ্টি এবং তারা আইয়ুব খানের প্রতি অনুগত ছিল।

৫. ‘৬২ এর ছাত্র আন্দোলন ও দমনপীড়ন: আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। মৌলিক অধিকার স্থগিত, সভা সমাবেশ ও সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন ছাত্র সমাজ, সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনীতিবিদগণ রাজনৈতিক আন্দোলনকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারায় রূপান্তরিত করে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানারে আইয়ুব বিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা চালায়।

৬. রাজনৈতিক দলবিধি জারি: আইয়ুব খান রাজনৈতিক দল বিধি জারি করে রাজনীতিবিদদের তাদের ইচ্ছামতো
কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়া থেকে বঞ্চিত।

৭. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতার: ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার হঠাৎ করেই করাচিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। এ সময় ছাত্রসমাজকে চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৬২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান এবং ৬ ফেব্রুয়ারি আবুল মনসুর আহমদ, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, রনেশ দাসগুপ্ত, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া প্রমুখকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়।

৮. ছাত্র আন্দোলন দমন: ‘শরীফ শিক্ষা কমিশন’ শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকোচনের চেষ্টা করলে ‘৬২ সালে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল ছাত্র বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কমিশনের গণবিরোধী সুপারিশে ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র সমাজ শিক্ষা দিবস পালন করে। এদিন ছাত্রসমাজের উপর নেমে আসে দমননীতির স্টিমরোলার। কার্জন হল এবং জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের মিছিলে সশস্ত্র বাহিনী গুলি চালায়।

৯. মুসলিম লীগের ভাঙন: আইয়ুব খান সর্বদা রাজনীতি ও গণতন্ত্র বিরোধী ছিলেন। ১৯৬৩ সালের মে মাসে তার নিজের নির্বাচন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তিনি মুসলিম লীগকে বিভক্ত করার ব্যবস্থা করেন এবং এর এক অংশের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে মুসলিম লীগের ভাঙন নিশ্চিত হয়।

১০. ছয় দফা দমন: আইয়ুব খান পূর্ব বাংলার উপর বেশি দমন পিড়ন ও বৈষম্য সৃষ্টি করে। এর বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা উত্থাপন করেন। ছয়দফা ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণের দাবী। ফলে পূর্ব বাংলার সর্বত্রই ছয়দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করে এবং আইয়ুব খান এ আন্দোলন দমন করতে এ গণদাবীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের গুলিতে নারায়ণগঞ্জে ১০ জন নিহত হয়।

১১. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা: শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা দাবি ছিল বাঙালির বাঁচার দাবি। এ দাবির সমর্থনে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়। এতে আইয়ুব বিরোধী তীব্র গণআন্দোলন শুরু হয়। ছয় দফা আন্দোলনে আইয়ুব খান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে এবং ১৯৬৮ সালে ৬ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা মামলা দায়ের করেন। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করা হয়।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আইয়ুব খান পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায্য দাবি ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে দমন ও নিপীড়ন চালায়। দমন, নিপীড়ন ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য ১৯৬৯ সালে ছাত্র সমাজ তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে। ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা দাবির প্রতি সর্বস্তরের জনতা আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান রাজনীতির মঞ্চ থেকে বিদায় নেয়। সমাপ্ত হয় আইয়ুব খানের দমন ও নিপীড়ন।