আইয়ুব খানের অবসান ও ইয়াহিয়ার শাসনকাল বিশ্লেষণ কর।

অথবা , আইয়ুব শাসনের পতনের কারণ ও ইয়াহিয়ার শাসনের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: আইয়ুব খান ১৯৫৮ সাল হতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১১ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তার শাসন আমলে দমনপীড়নের ফলে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। অবশেষে আইয়ুব খানের পতন হয় তখন শাসন ক্ষমতায় ইয়াহিয়া খান আসীন হন। ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। এ সময় ইয়াহিয়ার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। আইয়ুব খান হতে ইয়াহিয়া খানের প্রত্যাবর্তন:

১৯৫৮ সালের ইস্কান্দার মির্জা সামরিক সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। এ সময় সর্বাধিনায়ক হিসেবে আইয়ুব খানকে পদচ্যুত করার চেষ্টা করলে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। আইয়ুব শাসনামলে’ মৌলিক গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, দমন নিপীড়ন, রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব প্রভৃতি ছিল পূর্ণ। অতঃপর মুজিবের ছয় দফা দাবি উত্থাপন হলে। আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে ভারতের দোসর আখ্যায়িত করেন এবং আগরতলা মামলা দায়ের করেন। এতে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয় ও এক পর্যায়ে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় আগরতলা মামলা বাতিল ও আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবিতে ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ ও মওলানা ভাসানী ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। DAC গঠন করা হয় এবং আন্দোলনে বিস্ফোরণ সৃষ্টি হয়। ১৪৪ ধারা ছাত্রজনতা ভেঙে ফেলে এবং ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান নিহত হন। এ পর্যায়ে আইয়ুব শাসন-বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত রূপ নেয়। ফলে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে আইয়ুব খান বাধ্য হন এবং ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন এবং ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।

আইয়ুব খানের পতনের কারণ: আইয়ুব খান ছয় দফা প্রত্যাহার করে মামলা হামলার আশ্রয় নেন। আইয়ুব খান মামলার মাধ্যমে দমননীতির আশ্রয় নেন। কিন্তু ছাত্রজনতার গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয় ফলে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হন। এর পিছনে কতিপয় কারণ বিদ্যমান ছিল নিচে তা আলোচনা করা হলো:

১. রাজনৈতিক অধিকার খর্ব: ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার মধ্য দিয়ে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেন। এতে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়। জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পেতে গণআন্দোলনের মাধ্যমে আইয়ুব সরকারের বিরোধিতা করে ফলে আইয়ুব সরকারের পতন হয়।

২. ছয় দফার ভূমিকা: আইয়ুব সরকার পতনের জন্য শেখ মুজিবের ছয় দফার ভূমিকা ছিল প্রধান। ছয় দফা দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসন চায় ও পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলনের রূপ ধারণ করে তাতে আইয়ুব সরকার দমন নির্যাতন চালায় এতে গণআন্দোলন আরো তীব্র হয় ফলে আইয়ুব সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

৩. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য: আইয়ুব শাসন আমলে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তীব্র বৈষম্য বিরাজমান ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হতো। পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হতো পশ্চিম পাকিস্তানে, ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আইয়ুব সরকারের বিরোধিতা করে।

৪. ছাত্র আন্দোলন: ছাত্র আন্দোলন আইয়ুব সরকার পতনের’ অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। শরিফ শিক্ষা কমিশন অনুযায়ী শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে গণ্য, ব্যয়বহুল, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নতুন যড়যন্ত্র শুরু হয়। এ রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা ব্যাপক প্রচারণা, সভা-সমাবেশ, মিছিল, ধর্মঘট, চালিয়ে যেতে থাকে। দ্রুত এ আন্দোলন সমগ্র প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বস্তরের ছাত্ররা এতে অংশগ্রহণ করে। এতে আইয়ুব সরকারের পতনের ভিত্তিস্থাপন হয়।

৫. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন: আইয়ুব খান শরীফ কমিশনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে ও চাকরি ক্ষেত্রে ইংরেজির সাথে উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দেয়। এছাড়া, এ আদেশ বলে “নববর্ষ” পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।

৬. পাক-ভারত যুদ্ধ: ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব-বাংলা অরক্ষিত বা নিরাপত্তাহীনতায় ছিল। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে এ সম্বন্ধে ভাবিয়ে তোলে। ফলে পূর্ব, পাকিস্তানের মানুষ বুঝতে পারে আইয়ুব সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ বা চায় না। তাই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে আইয়ুব সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে।

৭. প্রচারমাধ্যম নিষিদ্ধকরণ: ১৯৬৬ সালে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত বাংলা পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক বন্ধ ও মুদ্রণযন্ত্র বাজেয়াপ্ত করে। এতে আইয়ূব সরকারের মুখোশ খুলে যায়, যা তার পতনের অন্যতম কারণ ছিল।

৮. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব: আইয়ুব সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে। ফলে মানুষ দ্বিধাবিভক্ত জীবনযাপন করে। অন্যায়, নির্যাতন, দমনপীড়ন বৃদ্ধি পায়। এতে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।

৯.National Democratic Front (NDF) গঠন: আইয়ুব সরকার সকল প্রকার রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ যোষণা করে। কিন্তু ১৯৬২ সালে আইয়ুববিরোধী সদস্যরা পূর্ব পাকিস্তানে এডভোকেট আফসার উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে National Democratic Front গঠন করে আইয়ুব সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে।

১০. ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ১৯৬৯ সালে ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন বিস্ফোরণ আকার ধারণ করে। আইয়ুব খানের ১৪৪ ধারা ভেতে ছাত্রজনতা আন্দোলনের মুখে অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব সরকারের পতন হয়।

ইয়াহিয়া শাসনের বৈশিষ্ট্য: ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব খানের পতন হলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে। তার শাসন আমলের কতিপয় বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় নিচে তা আলোচনা করা হলো:

১. রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসীস: আইয়ুব সরকার ব্যর্থ হলে তিনি সামরিক শাসন জারি করতে চাইলে ব্যর্থ হন। ফলে তিনি ২৪ মার্চ একপত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার গ্রহণে আমন্ত্রণ জানান। ইয়াহিয়া খান এভাবে রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হন।

২. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বাতিল: ইয়াহিয়া খানের ১৯৬২ সালের সংবিধান, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বাতিল ঘোষণা করেন। এটা ইয়াহিয়া খানের শাসন আমলের প্রধান ও প্রথম তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা বলে গ্রহণযোগ্যতা পায়।

৩. নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি প্রদান: ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, শীঘ্রই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। এ লক্ষ্যে তিনি নির্বাচনি কার্যক্রম চালু করেন ও ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

৪. রাজনৈতিক কার্যপ্রন চালু ইয়াহিয়া খান নির্বাচন কার্যক্রম চালু করার পূর্বে ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি হতে রাজনৈতিক কার্যকলাপের উপর বিধিনিষেধ তুলে নেদ, এতে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে আর বেগ পেতে হয় না। এতে গণতন্ত্র প্রক্রিয়া সুসংহত হয়।

৫. (LFO) Legal Framework order গঠন: ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে Legal framework order জারি করেন। আইনগত কাঠামো আদেশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ:

ক. সাধারণ নির্বাচন সংক্রান্ত বিধান:

১. সর্বজনীন ভোটাধিকার।

২. “এক ব্যক্তি” এক ভোট নীতি-

৩. প্রত্যেক প্রদেশ বা অঙ্গরাষ্ট্রের জন্য জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংখ্যা বণ্টন।

৪. প্রদেশগুলো পুনরুজ্জীবিতকরণ: ইয়াহিয়া খান নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য প্রদেশগুলোর পুনরুজ্জীবিত করেন। যা আইয়ুব সরকার বাতিল করেছিল। প্রদেশে জনসংখ্যার ভিত্তি তিনি আসন বণ্টন করেন। যেমন- পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯, পাঞ্জাবে ৮৫, সিন্ধু ২৮ ইত্যাদি।

৫. দুর্যোগ উপেক্ষা: ১৯৭০ সালে ১২ নভেম্বর ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে সমুদ্র উপকূলে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে ৫,০০,০০০ লোক মারা যায়। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী এলাকায় মানুষের জীবনে নেমে আসে বিভীষিকা। বাঙালির রাজনৈতিক নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন দুর্গতদের পাশে এলেভ ইয়াহিয়া খান এ দুর্যোগকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেন।

৬. যড়যন্ত্রকারী: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন লাভ করে। এ সময় ইয়াহিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়তে চায় না। জুলফিকার আলী ও ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বাঙালির উপর চূড়ান্ত আঘাত করার নীল নকশা ‘অপারেশন সার্চ লাইট” পরিকল্পনা অঙ্কন করেন।

৭. ঘৃণ্য শাসনামল: আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করেন। অবশেষে জুলফিকার আলী ও ইয়াহিয়া খান ঘৃণিত “অপারেশন সার্চ লাইট” পরিকল্পনা করে যার ফলে পূর্ব বাংলার ৩০ লাখ লোক শহিদ হয়। ৬ লক্ষের কাছাকাছি (মুনতাসীর) নারী ধর্ষিত হয়। ফলে ইয়াহিয়ার শাসনামল ঘৃণিত বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, প্রথমে ইয়াহিয়া ভালো মানুষী দেখালেও তার মনেও ছিল ক্ষমতার লোভ। আওয়ামী লীগ যে এভাবে নির্বাচনে জয়লাভ করবে তার তা জানা ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ইয়াহিয়া খানের ঘৃণ্য রূপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। তার চেয়ে ঘৃণ্য কাজ তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালান। এক কথায় বলা যায় আইয়ুব সরকার পতন ও আইয়ুবের চেয়েও নিকৃষ্ট ব্যক্তি ক্ষমতায় আসীন হন।