সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা, বাঙালির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভূমিকা আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি, সভ্যতা, রীতিনীতি, ঐতিহ্য, ভাষা, শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। বাঙালি জাতিরও তেমনি এরকম সংস্কৃতি ছিল, কিন্তু পাকিস্তানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান স্টিমরোলার চালায়। এজন্য বিভিন্ন সময় বাঙালি জাতি এ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলে।

বাঙালি সংস্কৃতি: বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে। পহেলা বৈশাখে নববর্ষ পালন করে। শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলার প্রাধান্য। জাতি হিসেবে তারা বাঙালি, তাদের আচার আচরণ, ভাষা, ঐতিহ্য, অনুষ্ঠান প্রায় একই। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন: বাঙালি সংস্কৃতি একদিনে গড়ে উঠেনি। দিনে দিনে বাঙালি জাতির মনের মধ্যে পুষে রাখা ঐক্য সংহতি প্রকাশ পায় বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। নিচে এ সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো:

১. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন: পূর্ব বাংলার ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা আর মাত্র ৭.২% ভাগ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিগণ উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চায়। ফলে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়, যার ফলে প্রাণ দেয় রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার। গড়ে উঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

২. শরীফ শিক্ষা কমিশন গঠন: শরীফ শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা, উর্দুকে জনগণের ভাষা রূপে পরিণত করার প্রয়াস চালায়। শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যয়বহুল করে তোলে অবৈতনিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি করে। ফলে বাংলার ছাত্র-জনতা শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।

৩. নববর্ষ উদ্যাপন বন্ধ: আইয়ুব খান বাঙালি সংস্কৃতির ধ্বংস করার জন্য নববর্ষ হিসেবে পহেলা বৈশাখ পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সময় বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেন।

৪. রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ: আইয়ুব খান সরকার এক আদেশবলে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এটা তিনি হিন্দুয়ানী সংগীত বলে আখ্যায়িত করেন। যা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রাসনী মনোভাব।

৫. ভারতের বইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা: আইয়ুব সরকার ভারতীয় বই আমদানি ও পড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ফলে বাঙালি সংস্কৃতিতে ভাটা পড়ে। তাই মনেমনে বাঙালি জাতি এক হতে থাকে।

৬. ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আইয়ুব সরকার এক অধ্যাদেশে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি করার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ফলে বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রাসন সুস্পষ্ট হতে থাকে দিন দিন।

৭. রেডিও ও টেলিভিশন নিষিদ্ধ: আইয়ুব খান মানুষের বিনোদনের অধিকার খর্ব করে। এক আদেশবলে রেডিও ও টেলিভিশন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবে বাঙালিকে সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তান নির্যাতনের চরম শিখরে গিয়ে বাঙালি জাতির সংস্কৃতিকে ভূলুণ্ঠিত করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু বাঙালি জাতি প্রতিটি পদক্ষেপে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে ১৯৫৬ এর সংবিধানে বাংলা ও উর্দু দুটি ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এটা ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তানিদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।