আগরতলা মামলা সম্বন্ধে কী জান?

অথবা, আগরতলা মামলা বলতে কী বুঝ?

অথবা, আগরতলা মামলা বিষয়বস্তু কী?

অথবা, আগরতলা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে একটি টীকা লিখ।

উত্তর। ভূমিকা: আগরতলা মামলা ছিল একনায়ক আইয়ুব খানের শাসনামলের এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। বাঙালির অধিকার আদায়ের লড়াই নস্যাৎ করতে এবং আওয়ামী লীগকে রাজনীতির ময়দান হতে নির্মূল হতে পাকিস্তানি শাসক চক্র এ ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করে। ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। এরই প্রেক্ষাপটে দায়ের করা হয় আগরতলা মামলা।

আগরতলা মামলা (১৯৬৮) : আইয়ুব খান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বাঙালি সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক একটি মামলা দায়ের করে, যা ‘আগরতলা মামলা’ নামে পরিচিত। এর আনুষ্ঠানিক নাম ছিল: ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’।

মামলার অভিযোগ: মামলার অভিযোগে বলা হয় মামলার এক নম্বর আসামি শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের সাহায্যে সশস্ত্র পন্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে এক যড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আরো বলা হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোগীরা এ ব্যাপারে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। এমনকি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এরা গোপন বৈঠকেও মিলিত হন।

বিচারস্থল প্রতিষ্ঠা বা নির্ধারণ: মামলার বিচারের জন্য ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব এক অর্ডিন্যান্স জারি করে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের ব্যবস্থা করেন। ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট ছিল বিচারস্থল। বিচারকার্য শুরু হয় ১৯ জুন থেকে।

মামলা দায়ের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া: সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় পাকিস্তানি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিচ্যুত ও অবসর গ্রহণকারী ব্যক্তিগণ পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এ সম্বন্ধে সরকার জানতে সক্ষম হয়।

১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি ২ জন সি. এস. পি. অফিসারসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয় এবং মোট ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন ও ডিফেন্স সার্ভিসেস আইনে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ জানুয়ারি এক প্রেস নোটে বলা হয় “ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ও পরিচালনার সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাজেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় তিনি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার হয়ে বন্দি অবস্থায় ছিলেন।
চার্জশিট গঠন: মামলার অভিযোগে বলা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৬৪ সাল থেকে বিভিন্ন স্থানে মিলিত হয় ও বৈঠকের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আরো বলা হয় এ মামলার দুই নম্বর আসামি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে তিনি একাধিক গোপন বৈঠক করেন। সর্বশেষ তিনি ১৯৬৭ সালে অভিযুক্তদের নিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় আগরতলায় গমন করে যড়যন্ত্রে নেতৃত্ব দেন।

মামলার আসামিগণ: এ মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। আর দুই নম্বর আসামি ছিলেন লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন ছিল CSP অফিসার। তারা হলেন আহমেদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস এবং খান মোঃ শামসুর রহমান। অভিযুক্ত অন্যরা স্টুয়ার্ড মজিবর রহমান, নূর মোহাম্মদ, মানিক চৌধুরী, সার্জেন্ট জহুরুল হক, ক্যাপ্টেন শওকত আলী, ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা, এ. কে. এম. তাজুল ইসলাম, আবদুর রউফ ইত্যাদি।

ট্রাইবুনাল গঠন: এ মামলায় ৩৫ জনকে আসামি করা হয় কিন্তু পরবর্তী ১১ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তারা সরকারের রাজসাক্ষী হয়। এ মামলায় ১১ জনসহ ২২৭ জন সাক্ষী ছিল। সরকার প্রথমে প্রতিরক্ষা আইন সার্ভিস ও পরে বিশেষ আদালতে বিচারব্যবস্থা করে। বিচারপতি এস, এ. রহমান, এম.আর, খান ও মুকসুদুল হাকিমকে নিয়ে এ আদালত গঠিত হয়।

একনায়ক আইয়ুবের উদ্দেশ্য: আইয়ুব সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে এ মামলা দায়ের করে। শেখ মুজিবুর রহমান ও
ছয়দফা আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য। ছয়দফা আন্দোলন জোরদার করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান জেলায় জেলায় ভাষণ দিতে থাকেন। তাতে আইয়ুব সরকার ভীতিসন্ত্রস্ত হয়। প্রথমে অস্ত্রের মুখে তাকে হুমকি দেয়। পরবর্তীতে তার নামে ডজন খানেক মামলা দায়ের হয়। আইয়ুবের গভর্নর মোনায়েম খান ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘যত দিন আইয়ুব খান গদিতে আসীন থাকিবেন তত দিন শেখ মুজিবকে শৃঙ্খলিত থাকিতে হইবে।’

গণঅভ্যুত্থান ও মামলা প্রত্যাহার: আপসহীন নেতাকে মামলায় অভিযুক্ত করা হয় এবং বিচারকার্য শুরু থেকে প্রচার কার্যে সম্প্রচার করা হয়। বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদীর চেতনা তৈরি হয়। তোফায়েল আহমেদ ও মওলানা ভাসানীর তীব্র ভূমিকা আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে ফেলে। তীব্র আন্দোলনের মুখে আইয়ুব সরকার টালমাটাল হয়ে পড়ে। অবশেষে ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি নেয় ও মামলা প্রত্যাহার করে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, আগরতলা মামলা প্রমাণ সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু আইয়ুব সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে এ মামলা পন্থা অবলম্বন করেছিল তা স্পষ্ট। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সামনে তা খড়কুটার মতো উড়ে যায়। ফলে আইয়ুব সরকার এ মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি নেয়।