অথবা, আগরতলা মামলার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বর্ণনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা: আগরতলা মামলা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক টানাপোড়েনের শিকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপট তৈরিতে এ মামলা ও মামলায় বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। বাঙালির দাবিদাওয়াকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার এ মামলা করে। ছয়দফা দাবি জোরালো হয়ে উঠলে পাকিস্তান সরকার তা দমনের উদ্দেশ্যে আগরতলা মামলা দায়ের করে।
আগরতলা মামলার প্রতিক্রিয়া:
পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা আন্দোলন কর্মসূচি পূর্ব
পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের চূড়ান্ত দাবিতে পরিণত হয়। পাকিস্তানের অপশাসন থেকে বের হয়ে স্বাধিকার অর্জনই ছিল ছয়দফা দাবির প্রধান লক্ষ্য। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা সবটুকু প্রয়োগ করতো এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করতো। স্বাধিকার আন্দোলনের ফলে তাদের ক্ষমতা ভিত নড়ে উঠে। ছয়দফা দাবির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব আয়, সম্পদ, বৈদেশিক আয় প্রভৃতি বিষয় সংযুক্ত করা হয়, যাতে সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয় এবং প্রদেশের সম্পদ প্রদেশের কল্যাণে কাজে লাগানো যায়। ফলে দেখা যায় যে, কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া প্রদেশে মিলিশিয়া বাহিনী গঠনকেও তারা ক্ষমতার প্রতি ঝুঁকি হিসেবে দেখেছিল। ছয়দফা আন্দোলন জোরদার হতে লাগলে পাকিস্তান সরকার তা দমনের জন্য নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। যার পদক্ষেপ স্বরূপ তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ১৯৬৮ সালে মামলা দায়ের করে। তারা দুইজন আওয়ামী লীগ নেতা, সিভিল সার্ভিসের দুইজন কর্মকর্তাসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করে। লোক মুখে এ মামলা ‘আগরতলা মামলা’ নামে পরিচিতি পায়। শেখ মুজিবুর রহমান এ মামলার নামকরণ করেছিলেন ‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে। এ মামলার সরকারি নাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য।’
ছয়দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। তাদের কাছে এ দাবি মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। কেননা তাতে কেন্দ্রের ক্ষমতা হ্রাস পাবে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, কেন্দ্র আর্থিক সংকটে পড়বে। তাই তারা আন্দোলনকারীদের জেলে নিক্ষেপ করে। কিন্তু সাধারণ জনগণ পাকিস্তান সরকারের এ ষড়যন্ত্র মূলক মামলার বিষয়টি জানতো। ফলে সমগ্র প্রদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। জনগণ জানতো যে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা আদায় করার জন্য লড়বেন। যে কারণে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। এদিকে আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনও দানা বেঁধে উঠে। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহার গণদাবিতে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়ে গঠন করে ‘ড্যাক’। ফলে আন্দোলন সাংগঠনিক রূপ পায়। বিভিন্ন স্থানে মিটিং মিছিল হয়, পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়, আহত হয় অনেকে। পাকিস্তান সরকার প্রতিহিংসাবশত ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকাবাসী রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলে পাকিস্তান সরকার প্যারোলে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তির প্রস্তাব দিয়ে গোল টেবিল বৈঠক আহ্বান করে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান তা প্রত্যাখ্যান করেন। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভকরে এবং ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও অভিযুক্তদের মুক্তি দেয়। আর এর ফলেই আইয়ুব খানের শাসনামল বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। মূলত ছয়দফা দাবি ও তা দমনের জন্য আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একত্রিত ও সংগঠিত হয়েছিল। সকল শ্রেণি/পেশার মানুষ এক হয়ে এক ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালায়। ফলে অনিবার্য পরিণতি হিসেবে পরবর্তীতে আইয়ুব খানের পতন হয়। এ মামলার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে এ আন্দোলনের চেতনা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আগরতলা মামলার প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ বিদ্বেষমূলক। ট্রাইব্যুনাল চেয়েছিল মিথ্যা মামলা দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদের ফাঁসিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে মেরে ফেলতে। কিন্তু প্রবল আন্দোলনের মুখে তাদের অপচেষ্টা ও মিথ্যা মামলা ব্যর্থ হয়। প্রতিহিংসাবশত তারা হত্যা করে বাঙালি বীর সন্তানদের ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি।