অথবা, ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানের কারণ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি আলোচনা কর।
উত্তর। ভূমিকা: পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে বিভিন্নভাবে শোষণ করতে থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতন ও উপেক্ষা করতে শুরু করল। পূর্ব বাংলার জনগণ তা ধীরে ধীরে বুঝতে পারল ও বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন আন্দোলন শুরু করলো। এভাবে আইয়ুব সরকারকে পতন করতে গিয়ে পূর্ব বাংলায় গণঅভ্যুথানের রূপ নেয় ১৯৬৯ সালে।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান হঠাৎ করে জন্ম লাভ করেনি। এর পিছনে কয়েকটি বিষয় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে যা নিচে আলোচনা করা হলো:
১. ছয় দফা দাবি: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি উত্থাপন করলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী শঙ্কিত হয়ে পড়ে- এই বুঝি পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়ে গেল। তাই শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহযোগীদের উপর অত্যাচার শুরু করে। এতে পূর্ব বাংলার জনগণ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে যা গণঅভ্যুত্থানের রূপধারণ করে।
২. পাকিস্তানি রাজনীতির বৈশিষ্ট্য: পাকিস্তানি বাহিনী বিশেষকরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য হলো একটু স্বার্থে আঘাত আসলে দমনপীড়ন শুরু করা। যেমন- ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ভাষার দাবি করলে কয়েকজনকে জীবন দিতে হয়েছিল, তেমনি শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন দাবি করলে তাকে গ্রেফতার ও রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দেওয়া হয়। এতে পূর্ব বাংলার জনগণ গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে।
৩. ৬ দফা দমননীতি: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান গড়ে উঠার জন্য মূলত ৬ দফার ভূমিকা ছিল প্রধান। ৬ দফা দাবির ভিত্তিতে নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, ৭ জুন পূর্ব বাংলার মানুষ ধর্মঘট পালন করে। এতে আইয়ুব খান ক্ষুব্ধ হয়। তিনি হুকুম দেন গুলি করার। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাত্র, শিক্ষক ও জনতার উপর গুলি বর্ষণ করে। এতে অনেক ছাত্র ও শিক্ষক নিহত হয়। ফলে আন্দোলন মহাআন্দোলনে রূপ নেয়।
৪. স্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মধ্যে ভাঙল : ৬ দফা দাবি উত্থাপন হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। জাতি পড়ে মহাসংকটে। ওয়ালী খান সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। ওয়ালী ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তানের নেতা ছিলেন মুজাফফর আহমদ। মুজাফফর আহমদ ৬ দফাকে সমর্থন করেনি। কিন্তু ভাসানীপন্থিরা বিরোধিতা করেন। ফলে ৬ দফা আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
৫. আইয়ুব সরকারের বিরোধিতা: ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করে। এতে জনগণ তাকে সাধারণভাবে মেনে নেয়নি। এছাড়া ১৯৬৪ সালের পর থেকে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে। আইয়ুব সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলনের আওয়াজ তোলেন পূর্ব বাংলার জনগণ। এভাবে দুই পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।
৬. উন্নয়ন দশক উদ্যাপন : ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান তার শাসনামলকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য উন্নয়ন দশক উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে জনগণ অংশগ্রহণ করেনি। উন্নয়ন দশকের অপচয় এ সরকারের পতনকে আসন্ন করে তুলেছিল। জনগণের টাকা খরচ করে সরকারের পক্ষে ঢাকঢোল পিটানোর কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল তা বিবেচনা করে পাকিস্তানিরা এতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
৭. গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন: দীর্ঘকালীন সময়ে পাকিস্তান সামরিক শাসনের অধীনে থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু জনগণের দাবি ও জনগণের অংশগ্রহণ না থাকায় তা সফল হয়নি। কিন্তু ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এর প্রতিনিধি মিলিত হয়ে ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন, যা গণঅভ্যুথানের পথকে সুগম করে।
৮. আগরতলা মামলা: শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফা দাবি পূর্ব বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এতে আইয়ুব খান স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আর তাই শুরু করে পূর্ব বাংলার জনগণের উপর জুলুম, নির্যাতন। এতে ফলাফল আশানুরূপ না হলে আইয়ুব খান মামলার পথ বেছে নেয়, যা আগরতলা মামলা নামে পরিচিত। এতে শেখ। মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে।
৯. ১১ দফা কর্মসূচি: ১৯৬২ সালের শিক্ষা ক্ষেত্রে কালাকানুন ও ১৯৬৬ সালের ছয় দফার ভিত্তিতে ছাত্রসমাজ ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। এতে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি ছাত্রগণ আন্দোলনের বেগ তীব্রতর করে তোলে। এতে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথানের সকল দিক ছিল ইতিবাচক। এ গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের মতো স্বৈরাচারী শাসকের পতন হয়। এর মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নতি স্বীকার করে। নিচে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল আলোচনা করা হলো:
১. আগরতলা মামলা প্রত্যাহার: ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের প্রধান ও প্রথম দাবিই ছিল আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে পূর্ব বাংলার জনগণ অনড় থাকে। অবশেষে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সব আসামিকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
২. শেখ মুজিবের পরিচিতি: ছয় দফা দাবির আগে শেখ মুজিবুর রহমানের তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। কিন্তু ছয় দফা দাবি উত্থাপন ও আগরতলা মামলার এক নম্বর আসামি হওয়ার পর তার পরিচিতি বেড়ে যায়। মুক্তি লাভ করে ২৩ ফেব্রুয়ারি এক সম্বর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়।
৩. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি: এরূপ পরিস্থিতিতে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। অবশেষে ১০ মার্চ আইয়ুব সভাপতিত্বে রাওয়ালপিন্ডিতে পুনরায় গোলটেবিল বৈঠক বসে। এ বৈঠকে ১০ মার্চ তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১. প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন।
২. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন।
৩. সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন।
৪. গোলটেবিল বৈঠক বর্জন বৈঠকে তিনটি বিষয় গৃহীত হলে ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি না মানায় আওয়ামী লীগ গোলটেবিল বৈঠক বর্জন করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এ সময় মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়।
৫. আইয়ুব সরকারের পতন: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব সরকার কোনোভাবেই যখন টিকছিল না তখন আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও আসামিদের বিনা শর্তে মুক্তি দাবি করা হয় এবং ১৯৬৯ এর মার্চ মাসের ২৫ তারিখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।
৬. ১৯৭০ সালের নির্বাচন: গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব ক্ষমতা ছাড়লে ইয়াহিয়া ক্ষমতায় আসে। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের পি. পি. পি. হেরে যায়। আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে।
৭. ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন: আইয়ুবের পতন, ইয়াহিয়ার নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের পতন, ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করা ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট যত হৃদয়বিদারক ঘটনা ধারণ করে। এর ফলাফল কিন্তু ততই সফলতা বয়ে আনে বাঙালির জীবনে। ১৯৬৯ সালের বাঙালি জাতি যে আন্দোলনের রূপ দেখিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে উদ্ভব হয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।