উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর গঠন ও কর্মসূচি আলোচনা কর।

অথবা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ এর পঠন এবং এদের কর্মসূচিসমূহ আলোচনা কর।

উত্তরঃ ভূমিকা: আগরতলা মামলার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ যখন চরম বিক্ষুব্ধ, ঠিক সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুববিরোধী বিক্ষোভ তীব্র হয়ে উঠে। ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্রগণ আন্দোলন আরম্ভ করে। বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের ফলে কিছুসংখ্যক ছাত্র নিহত হয়। ফলে আন্দোলন আরো ব্যাপক ও তীব্র আকার ধারণ করে।

‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন: ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করতে ছাত্রদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ছাত্রদের মধ্যে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মেনন ও মতিয়া উভয় গ্রুপের মধ্যে তখন কম্যুনিস্ট পার্টির ব্যাপক সমর্থন ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার পরই ঢাকায় ছয়দফা পন্থি আওয়ামী লীগের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কাউন্সিল সভায় আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রকে পার্টির আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। পার্টি ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানসমূহকে জাতীয়করণের এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বনের নীতি গ্রহণ করে। উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে অনেক প্রগতিশীল পরিবর্তন আনয়ন করা হয়। কমুউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠানের পর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের দুটি গ্রুপ এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একাংশ নিয়ে ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি একটি সর্বদলীয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ (Student Action Committee) গঠিত হয়। দেশে
যখন নেতৃত্বের অভাব, ঠিক তখনই ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি : ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ১১ দফা দাবি সংবলিত একটি কর্মসূচি ঘোষণা করে। নিচে কর্মসূচিগুলোর সংক্ষিপ্ত সার আলোচনা করা হলো:

১. সহেল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি পরিত্যাগ করতে হবে, শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য সর্বত্র বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ফুল-কলেজ স্থাপন করতে হবে এবং বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজসমূহকে সত্বর অনুমোদন দিতে হবে। ছাত্রদের বেতন শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করতে হবে। হল, হোস্টেলের ডাইনিং ও কেন্টিন খরচের শতকরা ৫০ ভাগ সরকার কর্তৃক ‘সাবসিডি’ হিসেবে প্রদান করতে হবে। মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে। ট্রেন, স্টিমার ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘পরিচয় পত্র’ দেখিয়ে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ‘কনসেশনে’ টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল করাতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।

২. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ও সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা; বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং দৈনিক ইত্তেফাকের উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে।

৩. পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে হবে। দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা সার্বভৌম হবে। ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা-এ কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যান্য সব বিষয়ে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ। দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে কিন্তু শাসনতন্ত্রে এমন বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হয়ে যায়। এ বিধান অনুসারে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। দুই অঞ্চলে দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করতে হবে। সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেশনের প্রতিটি রাষ্ট্র বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করবে এবং বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর এক্তিয়ারাধীন থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে।

৪. পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিটি বাতিল করে ‘সাব ফেডারেশন’ গঠন এবং বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুসহ সকল প্রদেশকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে হবে।

৫. ব্যাংক, বিমা, পাট ব্যবসায় ও বৃহৎ শিল্প কারখানাগুলোকে জাতীয়করণ করতে হবে।

৬. কৃষকদের উপর হতে খাজনা ও ট্যাক্সের হার হ্রাস করতে হবে এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করতে হবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল ও তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। পাটের সর্বনিম্ন মূল্য মণ প্রতি ৪০ টাকা নির্ধারণ এবং আখের ন্যায্য মূল্য দিতে হবে।

৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, বোনাস দিতে হবে এবং শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিক স্বার্থবিরোধী কালাকানুন প্রত্যাহার করতে হবে এবং ধর্মঘটের অধিকার ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান করতে হবে।

৮. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জল সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. জরুরি আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।

১০. সিয়াটো, সেন্টো, পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম করতে হবে।

১১. দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক সকল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি, গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহার এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক কারণে জারীকৃত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

উপসংহার: উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, ১৯৬৯ সালের ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ যে ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করে তা বাঙালির স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত। এ আন্দোলনের ফলেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একচেটিয়া আসন লাভ করে এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার করতে সাহস পায়। সুতরাং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর গঠন ও কর্মসূচি পেশ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা।